দুর্নীতি দমন কমিশনের সেই চাকরিচ্যুত উপ সহকারী পরিচালক ভদ্রলোক আমাদের কেজরিওয়াল হতে পারতেন। আম-আদমি পার্টির মতো দল খুলতে পারতেন। দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ বা মোর্চার ডাক দিতে পারতেন। অনশনে বসলে লাখো মানুষকে সঙ্গে পেতেন।
নিদেনপক্ষে এলাকার কিশোর-তরুণদের কম খরচে ব্যাচে ব্যাচে পড়িয়ে ভালোই সংসার চালাতে পারতেন। দুদক ও দুর্নীতির বিষয়ে ভেতরের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা লিখলে বেস্টসেলার হতো। আমাদের স্নোডেন কিংবা অ্যাসাঞ্জ হতে পারতেন। তাঁর নিজের আয়-উপার্জন ও সৃজন দুটোই হতো। জাতি দিকনির্দেশনা পাওয়ার মতো অনেক কিছুই পেত।
তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগত, চাকরি ছাড়া এ রকম আরও অনেক বিকল্প পেশা তিনি হয়তো বেছে নিতে পারতেন। পারতেন অনেক কিছুই। কেন পারেননি? সেসব কিছু ঘটেনি। কেন ঘটেনি? নিশ্চয়ই অসংখ্য বাধাবিপত্তি আছে। যা-ই হোক, নানা মোড়কে, নানা শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর হয়েছে, ‘দুদকের সেই উপ সহকারী পরিচালক এখন মুদিদোকানদার’।
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বিষয়টি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। তাই চাকরিনির্ভর শিক্ষিত ঘনিষ্ঠজন আশপাশে যাঁকেই পেয়েছি, জানতে চেয়েছি, খবরটি কি তাঁদের ভাবাচ্ছে এবং কী কী ভাবনা ভাবাচ্ছে। সবারই উত্তর ছিল একই রকম। এক. খবরটি প্রথম ঝলকেই নজর কেড়েছে।
দুই. মারাত্মক ভয় ধরিয়ে দিয়েছে, চাকরি হারালে সৎ মানুষদের দশাও সাবেক উপপরিচালকের মতোই হবে। তিন. জলে বসে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে লাভ নেই। বরং যেদিকে হাওয়া, সেদিকেই ধাওয়া ভালো। সুযোগ থাকলে দুর্নীতি করে হলেও নিজের দুরবস্থার সময়ের জন্য ভালো রকম টাকাপয়সা কামিয়ে সঞ্চয় করে রাখা দরকার ছিল। ভদ্রলোক পারেননি, কারণ তিনি বোকা। চার. মুদিদোকানে বসা অবশ্যই তাঁর মেধার অপচয়।
প্রত্যককেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, মোটিভেশনাল স্পিকারদের বচন ‘কোনো পেশাই বড়-ছোট নয়’, ‘নিজের ইচ্ছাশক্তিই ভাগ্য পরিবর্তনের উৎস’—আপনার মত জানান। সবারই বক্তব্য ছিল, এসব উচ্চ মধ্যবিত্তদের ভেতর থেকে উঠে আসা কুশলী চাপাবাজ যুবকদের ফাজলামো, ছেলেভোলানো কথাবার্তা। তারা হয়তো এতই শহুরে যে বৃহত্তর সমাজ বিষয়ে কোনো ধারণাই রাখে না।
শেষ প্রশ্নটি করেছিলাম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চাকরিচ্যুত হওয়ায় তিনি কি ভারতের কেজরিওয়ালের মতো দুর্নীতিবিরোধী নেতার আইকন হয়ে উঠতে পারতেন না? একটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার আন্দোলন মোর্চার কথা ভাবতে পারতেন না? উত্তর এসেছে, অসম্ভব। বাংলাদেশে প্রত্যেক মানুষকে এতটাই ভীত ও সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে যে দেশের ভেতর বসে কোনো সৎ ও সাহসী ভাবনা ভাবার আর কোনো সুযোগই নেই।
দেশে থাকা মেধাবী ও সৎ মানুষেরা দুর্নীতির চাপে পদে পদে নিগৃহীত হয়ে একসময় বিদেশে পালান। সম্প্রতি একজন সম্মানিত অধ্যাপক ও কৃষিবিদকে তাঁর গবেষণার কারণে পুরস্কৃত হওয়ার বদলে টিভি টক শোতে অপদস্থ হতে হলো। তবু এক দল মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে স্বদেশেই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমনই সংস্কার প্রয়োজন, যাতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মানুষদের সম্মানজনক না হোক, ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপন যেন না করতে হয়।
পেশা নেওয়ার বা ছেড়ে দেওয়ার অধিকার যার যার নিজের ব্যাপার। কোন পেশায় কে কী রকম আনন্দ পাবেন, সেটিও একান্তই যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের দেশেও অসংখ্যজন আছেন যাঁরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে উঁচু বেতনের সরকারি বা করপোরেট চাকরি করতেন। হঠাৎ সেসব ছেড়ে কৃষিকাজে বা ব্যবসায় নামলেন। পুকুর কেটে মাছ চাষ করবেন বলে কেউ কেউ গেলেন মফস্সলে ও গ্রামে। শিক্ষকতায় বা সাংবাদিকতায় গেলেন কেউ কেউ। কেউ উদ্যোক্তা হলেন। দুদকের চাকরিচ্যুত ভদ্রলোকের চলতি পেশাটি আগ্রহের আতিশয্যে বেছে নেওয়া পেশা নয়। পত্রিকার শিরোনাম, টিভির প্রতিবেদন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তোলপাড় অন্তত সে কথা বলে না। তাঁর অবস্থা ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা’!
তাঁকে ভাইয়ের মুদিদোকানটিতে গিয়ে সওদাপাতি বিক্রি করতে বসতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। চাকরিচ্যুত না হলে তিনি এই পেশা নিতেন না। চাকরি হারিয়ে আবার চাকরিই খুঁজেছেন। বিকল্প ভাবতেই পারেননি। তাঁর সাক্ষাৎকার নেব ভেবেছিলাম। দরকার হয়নি। মোটিভেশনাল স্পিকাররা যতই বুজরুকি কথাবার্তা বলুক না কেন, ব্যক্তি চাইলেই উদ্যোক্তা হয়ে যেতে পারেন না।
‘ভাগ্য নিজের হাতেই’ কথাটির অর্থও সাদামাটা নয়। ইত্তেফাক লিখেছে, ‘দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শরীফকে কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, চাকরির জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিয়েছি। কেউ চাকরি দেয়নি। বিদেশে চলে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম। পরে ভাবলাম, আমার মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন আছে। সেটি কে পরিচালনা করবে! ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা কে দেখবে! বড় ভাই বললেন, “আমার দোকানটা দেখাশোনা কর।” গত দেড় মাস যাবৎ দোকানে বসে বেচা-বিক্রি করছি। ছোট দোকান; বেচা-বিক্রি মোটামুটি হয়ে থাকে। আমার তিন বছর বয়সী এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।’ তাঁর বেলায়ও বাস্তবতা, আগে তো খেয়ে–পরে সন্তানসন্ততি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
দুদকের সাবেক উপ সহকারী পরিচালকের খবরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কারণ, গণযোগাযোগমাধ্যমগুলো পাঠক-দর্শকের অনুভূতি স্পর্শ করতে চেয়েছে এবং পেরেছে। ‘কর্মকর্তা এখন মুদিদোকানদার’ ধারণার মধ্যে মহত্ত্ব আরোপের চেষ্টা আছে, মমত্ববোধ তৈরির ইচ্ছাও আছে। শিরোনামের চটকদারি তো আছেই। কিন্তু কোথাও এই বিশ্লেষণ পেলাম না—‘মেধার অপচয়’টি আরও গভীর। তাঁর মাধ্যমে সমাজ ভালো কিছু পেতে পারত, পাচ্ছে না—এখানেই মেধার অপচয় ঘটছে। আরও দুটো বড় দুশ্চিন্তার বিষয় আছে। এক. তিনি বলেছেন, সিভি নিয়ে হন্যে হয়ে ধরনা দিয়েছেন এখানে-ওখানে। চাকরি হয়নি। কেন হয়নি? তিনি তো যোগ্যতায় পিছিয়ে নেই! কারণ কি এটিই নয় যে চাকরিদাতারাও তাঁকে চাকরি দিতে ভয় পাচ্ছেন?
তাঁদের ভয় থাকলে প্রশ্ন, কেন এবং কিসের ভয়? তাঁর প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীনদের ভয়? আতঙ্ক, ভয়, ক্ষতির আশঙ্কা আর প্রতিহিংসা ভীতিই কি তাঁকে বাধ্য করছে মুদিদোকানি হতে? দুই. তিনি বলেছেন, বিদেশে চলে যাওয়ার তাঁর সুযোগ ছিল। সেটি করলে অনেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অথচ এমন পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ আম-মানুষই বিদেশে চলে যেতে চান। সে ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে ব্যতিক্রম পেলাম।
সমাজবিজ্ঞান পড়তে আর পড়াতে গিয়ে আমরা মেধা পাচারের কথা আলোচনায় নিই। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই, তবে বিশ্ববিদ্যালয় মহলে চাউর আছে, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) গ্র্যাজুয়েটদের ৮৫-৯০ ভাগই উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গেলে আর ফেরেন না।
দেশে থাকা মেধাবী ও সৎ মানুষেরা দুর্নীতির চাপে পদে পদে নিগৃহীত হয়ে একসময় বিদেশে পালান। সম্প্রতি একজন সম্মানিত অধ্যাপক ও কৃষিবিদকে তাঁর গবেষণার কারণে পুরস্কৃত হওয়ার বদলে টিভি টক শোতে অপদস্থ হতে হলো। তবু এক দল মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে স্বদেশেই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমনই সংস্কার প্রয়োজন, যাতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মানুষদের সম্মানজনক না হোক, ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপন যেন না করতে হয়।
সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির প্রস্তাব আসে শরীফের। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশে মেধার অপচয়ের প্রশ্নটি আরও গভীর।
হেলাল মহিউদ্দীন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। রিসার্চ ফেলো, সেইন্ট পলস কলেজ, ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা