আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বাস্তববাদী বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, শীতল যুদ্ধের পর জাপান আবার বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আগের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ফিরে যাবে। ১৯৯৩ সালে কেনেথ ওয়াল্টজ তাঁর নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘জাপান আবার বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। জাপানের সামরিক সংস্থা ও সেগুলোর আচরণ থেকে এর ইঙ্গিত মিলছে।’
বিশ্বে ‘সভ্য শক্তি’ হিসেবে জাপানের ভাবমূর্তি রয়েছে। ‘পারমাণবিক অস্ত্র’-এর প্রতি দেশটির বিরূপ মনোভাবও রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এর যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, সেই ঘটনাপ্রবাহ থেকেই জাপান শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রেখে আসছে।
জাপানের নিরাপত্তানীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ খ্রিস্টোফার হিউস তাঁর নতুন বইয়ে জাপানকে বিশ্বের একটি সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তাঁর দাবি হলো, আরও শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার সব চিহ্নই জাপান প্রদর্শন করছে। শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক স্তরেও সামরিক শক্তি হতে চলেছে জাপান।
প্রতিরক্ষা সক্ষমতা না থাকলে কোনো দেশকে বৈশ্বিক সামরিক শক্তি বলা যায় না। হিউস তাঁর আগের বইগুলোতে দেখিয়েছেন, জাপান ধারাবাহিকভাবে সামরিকায়নের পথে এগিয়েছে। এর শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। সে সময়ে জাপান আত্মপ্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়াসুহিরো নাকাসোনে, জুনিচিরো কোইজুমি ও শিনজে আবের আমলে সেই শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। কোইজুমি খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, জাপান ‘স্বাভাবিক’ দেশ হয়ে উঠবে। আবে বলেছিলেন, জাপান কখনো দ্বিতীয় স্তরের দেশ হতে চায় না। হিউসের যুক্তি হলো, আবের আমলেই প্রথম স্তরের দেশ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
অনেক পর্যবেক্ষক এখন পর্যন্ত জাপানকে যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের সমকক্ষ বৈশ্বিক সামরিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই জাপান বিশ্বে তার সামরিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আগের কৌশলগত অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। এর আগে জাপানে অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল, প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বে আর কোনো প্রতিরক্ষা অংশীদার ছিল না। জাপানের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের ভূখণ্ড প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত ছিল। বিশ্বের অন্য কোথাও তাদের অবস্থান ছিল না।
কয়েক দশক আগে বাস্তববাদী বিশ্লেষকেরা যে পূর্বধারণা করেছিলেন, তার থেকেও সামরিক শক্তির দিক থেকে জাপান অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রথাগত পরাশক্তির যে ধরনের সামরিক সক্ষমতা প্রয়োজন, তার অনেকগুলোই এখন জাপানের হাতে রয়েছে। জাপান তাদের নিরাপত্তানীতি কেন্দ্রীভূত করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে। এ ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া থেকে এটা স্পষ্ট যে জাপান অন্য পরাশক্তির পথ অনুসরণ করছে।
এ ছাড়া জাপান প্রতিরক্ষা কাঠামো পুনর্গঠন করেছে। ভূমি, সমুদ্র, আকাশ, মহাকাশ, সাইবার পরিসর ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্রে যে হুমকি, তা মোকাবিলার উপযোগী বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলছে। জাপানের সেনাবাহিনী এমন একধরনের সেতুব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেটিকে জলে ও স্থলে দুই স্থানেই দ্রুততার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। আগের যুদ্ধজাহাজগুলো উন্নত করেছে। সাবমেরিনের সংখ্যা ও গুণগত মান বাড়িয়েছে। আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে হামলার সক্ষমতাও বাড়িয়েছে।
এ ধরনের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব আইনি বাধা ছিল, সেগুলো অপসারণ করেছেন জাপানের নীতিনির্ধিরকেরা। ২০১৬ সালে দেশটিতে শান্তি ও নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এই আইনে সামগ্রিক প্রতিরক্ষার বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। অস্ত্র রপ্তানির ওপর আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাও শিথিল করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা বাজেটে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নানা কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছে জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা জোট গড়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বে বেশ কিছু কৌশলগত জোটের অংশীদার হয়েছে তারা। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইন; ইউরোপে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এখন জাপানের কৌশলগত মিত্র। ন্যাটোর সঙ্গেও প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারত্ব গড়ে উঠেছে জাপানের।
জাপানের নৌবাহিনীর কার্যক্রম এখন শুধু ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই, হর্ন অব আফ্রিকাতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে তারা। এর আগে জাপান বেশ কিছু শান্তি রক্ষা মিশন ও জলদস্যুবিরোধী অভিযানে তাদের বাহিনী পাঠিয়েছিল। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী অভিযানের সময়েও জাপানের সেনাবাহিনী সহায়তা করেছিল।
অনেক পর্যবেক্ষক এখন পর্যন্ত জাপানকে যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের সমকক্ষ বৈশ্বিক সামরিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই জাপান বিশ্বে তার সামরিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আগের কৌশলগত অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। এর আগে জাপানে অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল, প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বে আর কোনো প্রতিরক্ষা অংশীদার ছিল না। জাপানের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের ভূখণ্ড প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত ছিল। বিশ্বের অন্য কোথাও তাদের অবস্থান ছিল না।
অন্য যেসব দেশ সামরিক দিক থেকে অগ্রসর ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যাদের উপস্থিতি আছে, তারা জাপানকে ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখে। প্রতিরক্ষা খাতে জাপানের শক্তিবৃদ্ধিকে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বন্ধুদেশগুলো। আবার চীনের মতো সামরিক সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র জাপানের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিকে নেতিবাচক দিক থেকে দেখে।
এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা ফ্রান্স যে ধরনের সামরিক শক্তি, জাপান এখনো সেই স্তরে পৌঁছায়নি। দূরপাল্লার বোমারুবিমান কিংবা পারমাণবিক অস্ত্র জাপানের কাছে নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপান তাদের সামরিক নীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
থমাস উইলকিনস অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত