মতামত

টুইটার কবজা করে যেভাবে স্বৈরাচারী হলেন ইলন মাস্ক

ইলন মাস্ক টু্ইটারের মালিকানা নেওয়ার পর দৃশ্যত প্রতিষ্ঠানটিতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলে অনেকে সমালোচনা করছেন।
ছবি: রয়টার্স

ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মতো আমিও এই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিটির বিদ্যমান বিপর্যয়ের দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখছি।

আমি এবং বিশেষত যাঁরা আমার মতো স্বৈরশাসনের দেশ থেকে এসেছেন, তাঁদের জন্য অবাধ বিতর্ক এবং তথ্য আদান-প্রদানের এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হারানোর ভয়ই যে শুধু আমার মধ্যে কাজ করছে তা নয়। এর বাইরেও একজন রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট হিসেবে আমি সেই প্ল্যাটফর্ম হারানোরও ভয় পাচ্ছি, যেখানে আমি এবং আমার অনেক সহকর্মী আরব বসন্তের সময় আমাদের আন্দোলন শুরু করেছিলাম (যা টুইটারকে আজকের এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে)।

টুইটার নিয়ে ঘটনা এখন যে পর্যায়ে এসেছে, তা সম্ভবত অনিবার্য ছিল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি-পূজার সংস্কৃতির লালন করছে। এই সংস্কৃতির শুরুটা করেছিলেন স্টিভ জবস। তিনি অতি সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে নিজের উদার ও কৌতূহলী উদ্ভাবকের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ‘কঠোর-নিয়ন্ত্রিত একটি করপোরেশনের’ প্রধান ছিলেন। জবস সারা জীবন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তাঁর আইকনিক অবস্থান অনুসরণ করে উঠে আসা উত্তরাধিকারীরা তাঁর মূল্যবোধ ও আদর্শকে মোটেও অনুসরণ করেননি। তাঁরা তাঁদের নিজেদের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিজেদের উদ্যমকে রাজনীতির হাতে সঁপে দিয়েছেন এবং নিজেদের কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারের এজেন্ডাগুলোকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন।

টুইটারের মালিকানা কেনার পেছনে ইলন মাস্কের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তা তিনি গত মে মাসে (তখন টুইটার কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্তও হয়নি) তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে করা একটি পোস্টেই খোলাসা করেছিলেন। সেখানে তিনি ফ্রান্সের ‘সূর্যরাজ’খ্যাত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের একটি ছবি পোস্ট করেন। এর মাধ্যমে ইলন মাস্ক নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন ‘আলোকিত’ রাজা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন বলে মনে করা হয়। ওই সময় তিনি টুইটারকে একেবারে ‘অবাধ’ করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন।

কিন্তু গত দুই মাস ধরে মাস্কের কার্যকলাপ ও প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁকে ‘একজন মহান সূর্যরাজের’ চেয়ে কম উদার এবং একটি প্রায় ভেঙে পড়া রাজ্যের একজন আধুনিক স্বৈরশাসকের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে।

একজন উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা দখলকারীর মতো তিনি ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘জনগণের ইচ্ছা’র কথা বলে টুইটার দখল করা শুরু করেছিলেন, এবং এর মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্র এবং জনগণের ইচ্ছা—উভয়কেই উপহাস করেছেন। তিনি নিজে যে টুইটারকে ‘ডিজিটাল টাউন স্কয়ার’ বলে অভিহিত করে থাকেন, সেটিকেই তিনি এমনভাবে ব্যক্তিগত পরিসর বানিয়েছেন যেখানে তাঁর কথাই শেষ কথা।

আর দশজন স্বৈরশাসকের মতো মাস্কও ভিন্নমত ও সমালোচনার প্রতি সহনশীলতা দেখাননি। কোম্পানির মধ্যে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখানোর জন্য তিনি কর্মীদের চাকরি খেয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।

একজন কট্টর কর্তৃত্ববাদীর মতো তিনি গণমাধ্যমে ঘৃণা করেন এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়্গ তুলতে দ্বিধা করেন না (যদিও তিনি নিজেকে বাক স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসাবে উপস্থাপন করে থাকেন)। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, তিনি এমন বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের টুইটার অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছিলেন যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেছিলেন।

একজন স্বৈরশাসকের মতো মাস্ক নির্দয় শোষণের মাধ্যমে যতটা সম্ভব সম্পদ আহরণ করতে চাইছেন। তিনি কর্মীদের আনুতোষিক সুবিধা বাতিল করেছেন, কর্মচারীদের অবিরাম কর্মদিবসে নিয়োজিত থাকতে বাধ্য করেছেন এবং এমনকি টুইটার সদর দপ্তরে বিছানা পেতেছেন যাতে তার কোম্পানির কর্মীরা সেখানে বিশ্রাম নিতে পারে এবং তাঁদের কর্মশক্তি যাতে কোম্পানির চৌহদ্দির বাইরে খরচ না হয়। এবং একজন ‘ভালো’ অত্যাচারীর মতো তিনি তাঁর ডোমেইন থেকে লোকেদের নির্বাসনে যাওয়া দেখছেন: কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন, অন্যরা ‘নির্বাসনে’ যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রকৃতপক্ষে, টুইটারের প্রাক্তন কর্মীদের জন্য আমার মায়া লাগছে। আমি খুব ভালো করে জানি, একজন স্বৈরশাসক বা স্বৈরাচারের কারণে প্রিয় জায়গাটি ছেড়ে যেতে আপনার কেমন লাগে।

আমার এবং আমার পরিবারের নির্বাসনের জন্য যে ব্যক্তি দায়ী, তিনি হলেন ওমর আল-বশির। তিনি ১৯৮৯ সালে সুদানে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ভিন্নমতের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র সহনশীলতা ছিল না। যে প্রতিভাধর ব্যক্তিই তাঁর অনুগত ছিল না, তাঁকেই তিনি দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতেন। ফলে দেশটি মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে। তিন দশক ধরে তিনি দেশ শাসন করছেন। এর মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছে, একাধিক জাতিগত সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। একটি গণহত্যা হয়েছে।

একটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং দেশটি এখন অর্থনৈতিক পতন দেখছে। তিনি দেশটিকে নিজের পায়ের নিচে দাবিয়ে রেখেছেন এবং প্রেসিডেন্ট বশির তাঁর প্রাপ্য হিসেবে সুদানের বেশির ভাগ মানুষের ঘৃণা ‘অর্জন’ করেছেন। তিনি জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিলেন এবং অবশেষে ২০১৯ সালে একটি শান্তিপূর্ণ গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর পতন হয়েছিল।

টুইটারেও মাস্ককে ব্যাপকভাবে অপছন্দ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ডিসেম্বরে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে ডেভ চ্যাপেলের স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শোতে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে প্রবলভাবে দুয়োধ্বনি দেওয়া হচ্ছিল এবং তিনি একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।

ইলন মাস্ক আমাকে আল-বশিরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সুদানের সাবেক একনায়কের সঙ্গে এই টেক টাইকুনের যে বড় মিলটি পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো তাঁরা দুজনই ক্রমবর্ধমান জন-ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখেও ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
টুইটার কিনে দায়িত্বে বসার পর থেকে মাস্কের সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত অজনপ্রিয় ছিল। তিনি শুধুমাত্র টুইটার ব্যবহারকারী, আইটি বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবসায়িক ভাষ্যকারদের কাছ থেকে সমালোচনার মুখে পড়েননি, তাঁকে ইইউয়ের ডিজিটাল প্রধান থিয়েরি ব্রেটনসহ সরকারি কর্মকর্তাদের তরফ থেকেও সতর্ক বার্তাও পেয়েছেন।

টুইটারেও মাস্ককে ব্যাপকভাবে অপছন্দ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ডিসেম্বরে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে ডেভ চ্যাপেলের স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শোতে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে প্রবলভাবে দুয়োধ্বনি দেওয়া হচ্ছিল এবং তিনি একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।

বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মুখোমুখি হওয়ার ভিডিওগুলো অনলাইনে যথেষ্ট হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে মাস্ক টুইট করে দাবি করেছিলেন, ‘এই ধ্বনির মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল হর্ষোধ্বনি এবং ১০ শতাংশ ছিল দুয়োধ্বনি’। পরে অবশ্য তিনি টুইটটি মুছে ফেলেছিলেন। মাস্ক তাঁর অজনপ্রিয়তাকে এতটাই অস্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, লোকেরা যদি সিইও পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের পক্ষে ভোট দেয় তাহলে তিনি সরে দাঁড়াবেন। লোকেরা তা-ই করল। ৫৭.৫ শতাংশ ভোট পদত্যাগের পক্ষে পড়ল। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করলেন না।

ফলাফলটি স্বীকার করতে মাস্কের ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে এবং ফল মেনে নেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র তখনই পদত্যাগ করবেন যখন তিনি অন্য কোনো যোগ্য কাউকে পাবেন। এটি স্বৈরশাসকদের অতি পুরোনো কৌশল। তাঁরা এমন ভান করেন যে, তাঁরা ছাড়া আর গদিতে বসার আর কোনো যোগ্য লোক নেই। এটি তাঁদের অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করে দেয়।

কিন্তু আল-বশিরের সঙ্গে মাস্কের যে বিষয়ে মিল নেই, তা হলো জাহাজ যখন ডুবছে তখনো মাস্ককে তাঁর অনুগতরা ভেসে থাকার সাহস দিয়ে যাচ্ছেন।
মাস্ক তাঁর সম্পদের জোরে এই শক্তি পেয়েছেন। কিন্তু এই শক্তি বাজার-শক্তির ওপর নির্ভর করে যাতে কাঁর পুরোপুরি হাত নেই। বড় বিনিয়োগকারীরা যারা তাঁর বিভিন্ন টেক অ্যাডভেঞ্চারকে সক্ষম করেছেন, তাঁরা অনুগতদের তুলনায় অনেক বেশি চঞ্চল। তাঁরা আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বিপদের সামান্যতম চিহ্ন দেখলেই তাঁকে ফেলে ঝাঁপ দেবেন।

আল-বশির এবং অন্যান্য পতিত স্বৈরশাসকদের মতো ইলন মাস্ক একই ভুল করছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি জনগণের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছেন।
মাস্কের ডিজিটাল স্বৈরাচারের অবসান ঘটবেই—দুদিন আগে হোক বা পরে হোক। কিন্তু তার ত্রুটিপূর্ণ শাসন তাঁর অন্যান্য ‘প্রযুক্তি-ভাইদের’ জন্য একটি সতর্কতা হিসাবে দাঁড়ানো উচিত যারা প্রযুক্তির স্বৈরশাসক হওয়ার অভিলাষ লালন করে। তাঁদের মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট—বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের স্বাধীনতার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এটি দখল ও নিয়ন্ত্রণ করার যে কোনো চেষ্টা ব্যর্থ হবেই।

  • আল জাজিরা থেকে নেওয়া
    অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    খালিদ আলবাইহ রোমানিয়ান বংশোদ্ভূত সুদানি রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট। তিনি বর্তমানে ডেনমার্কে বসবাস করছেন ও সেখানে সাংস্কৃতিক প্রযোজক হিসেবে কাজ করছেন।