প্রথমে কন্যা গেলেন। তারপর স্ত্রী। সর্বশেষ তিনিও চলে গেলেন।
বলছি, আমাদের প্রিয় লেখক-ভাবুক আকবর আলি খানের কথা। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। এসব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর লেখকসত্তাটিই বড় হয়ে ওঠে। যখন দেশে সত্য বলার মানুষের বড় অভাব, তখন তিনি সাহস করে সত্য বলতেন। কে কী ভাবলেন, পরোয়া করতেন না। তিনি ছিলেন সর্বাংশে দলীয় বৃত্তের বাইরের মানুষ।
আকবর আলি খানের সঙ্গে শেষ দেখা হয় প্রায় এক মাস আগে। গুলশান-১-এর ২৭ নম্বর সড়কের বাড়ির ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তিনি শাশুড়িকে নিয়ে। একজন কন্যা-নাতনিকে হারানো এবং অপরজন স্ত্রী-কন্যাকে হারানোর বেদনার ভার নিয়ে। আকবর আলি খানও চলে গেলেন। এখন তাঁর শতবর্ষী শাশুড়ি জাহান আরা একেবারেই একা।
আকবর আলির সঙ্গে সাক্ষাতে কিংবা টেলিফোনে যখনই আলাপ হতো, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়েই কথা বলতেন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বলতেন। ব্যক্তিগত জীবনের কথা তেমন বলতেন না। কিন্তু হৃদয়ে তাঁর রক্তক্ষরণ অনুভব করতাম। একদিন আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, যে শাশুড়িকে তাঁর দেখাশোনা করার কথা, সেই শাশুড়িই এখন তাঁর দেখাশোনা করছেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে আকবর আলি খান অসুস্থ ছিলেন। এই অবস্থায়ও নিয়মিত লিখতেন। নিজে লিখতে না পারলে অন্যকে ডিকটেশন দিতেন। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য—যেকোনো বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন।
মনে আছে, একবার জাতীয় জাদুঘরে প্রথমার অনুষ্ঠানে আকবর আলি খান বলেছিলেন, কোনো বিষয়ে লেখার আগে তিনি ভাবেন, পড়াশোনা করেন, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এ কারণে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করলেও তাঁর যুক্তি খণ্ডন করা কঠিন ছিল। আবার তিনি কোনো বিষয়ে লিখলে সেটাকে চূড়ান্ত মত বলে মনে করতেন না। তাঁর ডিসকভারি অব বাংলাদেশ বইটি বহুল পঠিত ও নন্দিত। কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেদিন আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, ওই বইয়ে ইতিহাসের পরম্পরা সেভাবে আসেনি। এ বিষয়ে আরেকটি বই লেখার ইচ্ছা আছে তাঁর। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ সম্পর্কেও একই কথা বললেন। তিনি ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে আমাদের বোঝালেন। বাংলা ভাষার সবচেয়ে ইতিহাসসচেতন কবি জীবনানন্দকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন আরেক ইতিহাসবিদ।
স্বাধীনতার পর একবার আকবর আলি খান সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মতো মেধাবী কর্মকর্তার দরকার আছে। এরপর তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশে যান পড়াশোনা করতে। সেখানে একবার অসুস্থও হয়ে পড়েন। ১৯৭৯ সালে দেশে এসে কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন। জীবনের চক্রে আবার তাঁকে পুরোনো পেশায় ফিরে আসতে হয়। কিন্তু সেটাই তাঁর প্রধান পরিচয় নয়।
গত বইমেলায় তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড পুরানো সেই দিনের কথা বের হয় প্রথমা থেকে। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ চলছিল। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ‘দ্বিতীয় খণ্ড হয়তো আমার মৃত্যুর পর ছাপতে হবে। কেননা, এই বইয়ে এমন কিছু থাকবে, যা অনেকে সহ্য করতে পারবেন না।’ বললাম, আপনার লেখা নিয়ে যত বিতর্ক হোক, জীবদ্দশাতেই দ্বিতীয় খণ্ড বের করুন। এ থেকে মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে পারবে। শুনেছি, সে রকম প্রস্তুতিও চলছিল। এরই মধ্যে এল ভয়ংকর সংবাদ—তিনি নেই।
আকবর আলি খানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় নব্বই দশকের শেষার্ধে। তখন সংবাদ-এ কাজ করি। তিনি সরকারের অর্থসচিব। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন—এ রকম ছয়জন সিএসপি কর্মকর্তাকে নিয়ে তাঁর কক্ষেই একটি স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন, মুজিবনগর প্রশাসনে কাজ করলেন, সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, আকবর আলি খান তখন হবিগঞ্জের এসডিও। কীভাবে সরকারি মালখানা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়েছিলেন, সীমান্ত পার হয়ে মুজিবনগর সরকারের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন, সেসবও বলছিলেন। পুরানো সেই দিনের কথা বইয়েও এর বিস্তারিত বিবরণ আছে।
দ্বিতীয়বার তাঁর সঙ্গে কথা হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী রেজিনা বেগমের সূত্রে। তখন ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। উপদেষ্টাদের জন্য নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাব গিয়েছিল উপদেষ্টা পরিষদে। সেই সময়ে রেজিনা বেগম বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে যান আমন্ত্রিত হয়ে। সেখানে সব অতিথিকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছিল। রেজিনা বেগম নিজের প্যাকেট নেওয়ার পর পড়ে থাকা আরও দু-একটি প্যাকেট সংগ্রহ করছিলেন। এ নিয়ে জনকণ্ঠ-এ একটি খবর ছাপা হয়। এরপর আমি যুগান্তর-এ কলাম লিখেছিলাম, ‘উপদেষ্টাদের বিলাসী গাড়ি ও বঙ্গভবনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা–পত্নীর খাবার সংগ্রহ।’
সেটি যেকোনোভাবে আকবর আলি খানের চোখে পড়েছিল। এক টিভি সাংবাদিক বন্ধু এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যে দেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, সেই দেশে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী খাবার টুকিয়ে খাবেন, এটা কোনোভাবে মানতে পারি না। আমি কখনো বঙ্গভবনে যাব না।’ পরে অবশ্য ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে সেই গাড়ি কেনার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছিল।
তার আগের আরেকটি ঘটনায় আকবর আলি খানকে আমরা জাতির বিবেক হিসেবে পাই। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। যখন বুঝতে পারলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না, সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পক্ষপাত করছেন, তখন আকবর আলি খান এবং অপর তিন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেই পদত্যাগ নিয়ে উপহাসও করেছেন। অথচ তঁাদের পদত্যাগের কারণেই ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের দুরভিসন্ধি ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল।
আবার রেজিনা বেগমের ঘটনায় আসি। তাঁকে খুঁজে বের করে আমরা কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। ভাবলাম, সেই অনুষ্ঠানে আকবর আলি খানই হতে পারেন যোগ্যতম ব্যক্তি। তাঁর বাড়িতে গিয়ে জানলাম, তিনি অসুস্থ। নিজে যেতে না পারলেও রেজিনা বেগমকে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ, ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদসহ আরও অনেকে সহায়তা দিয়েছিলেন। এই দুজনও আজ আমাদের মাঝে নেই।
প্রথম আলোতে আসার পর আকবর আলি খানের সঙ্গে যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়। মাঝেমধ্যে সেমিনারে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। অত্যন্ত সাদামাটা ভাষায় কথা বলতেন। বাসায়ও অনেকবার গিয়েছি। টিভি টক শোতেও দেখা হতো। সব সময় তাঁকে মনে হতো ধ্যানমগ্ন ঋষি। দেশে এত বিবাদ, রেষারেষি, কিছু পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা—কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আবার দেশ নিয়ে তঁার কোনো আক্ষেপ ছিল না। গত ১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় তাঁর যে সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল, তাতেও তিনি আশাবাদের কথা শুনিয়েছিলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশকে নিয়ে আমি আশাবাদী। ১৯৭১ সালে আমরা যে বাংলাদেশ দেখেছি, তার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষটিও যেভাবে একটি মুঠোফোনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারে, অনেক দেশে এখনো তা অকল্পনীয়।’
অসাধারণ ধীশক্তি ছিল বলে যেকোনো দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছেন আকবর আলি খান। তবে আমলা–জীবনের সঙ্গে কখনোই নিজেকে একাকার করেননি তিনি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের দেশে আমলা হলে অনেকের লেখকসত্তা হারিয়ে যায়। আবার অনেকে আমলা লেখক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে আগ্রহী হন। আপনি দুই সত্তাকে কীভাবে আলাদা করলেন? তিনি বললেন, ‘আমি আমলাগিরি উপভোগ করিনি কখনো। যাঁরা উপভোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যেই দুই জীবন নিয়ে টানাপোড়েন থাকে। আমার ছিল না।’
স্বাধীনতার পর একবার আকবর আলি খান সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মতো মেধাবী কর্মকর্তার দরকার আছে। এরপর তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশে যান পড়াশোনা করতে। সেখানে একবার অসুস্থও হয়ে পড়েন। ১৯৭৯ সালে দেশে এসে কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন। জীবনের চক্রে আবার তাঁকে পুরোনো পেশায় ফিরে আসতে হয়। কিন্তু সেটাই তাঁর প্রধান পরিচয় নয়।
আকবর আলি খানের ছিল অফুরন্ত জীবনতৃষ্ণা। তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল বাংলাদেশ, যে দেশটির অভ্যুদয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তঁার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি