জয়শঙ্কর-বিলাওয়াল বৈঠক নয়, করমর্দন হবে কি

বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ কীভাবে কাটবে, তা নিয়ে একটু চিন্তায় রয়েছে ভারত। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।

৪ ও ৫ মে গোয়ায় এসে তিনি কী করবেন বা করতে পারেন, কী বলবেন বা বলতে পারেন, চিন্তা ও কিছুটা দুশ্চিন্তা তা নিয়েই। কারণ, পাকিস্তানের এই সর্বকনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বিলাওয়ালের বয়স ৩৪) গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি আক্রমণ করে বলেছিলেন, ‘ওসামা বিন লাদেন নিহত, কিন্তু গুজরাটের কসাই বেঁচে আছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী।’

ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের তাল অনেক দিন ধরেই কাটা। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন নওয়াজ শরিফ। সম্পর্কের উন্নতি যতটুকু হচ্ছিল, ওই বছরেই কাশ্মীরের হুরিয়াত নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বৈঠক তা বিলীন করে দেয়। সেই থেকে বন্ধ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা আজও শুরু হয়নি। যখন মনে হয় পরিস্থিতি একটু অনুকূল, তখনই কিছু না কিছু ঘটে।

কারগিল ছিল তেমনই এক ঘটনা। পুলওয়ামা-কাণ্ডও। কিংবা জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা খারিজ ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়া। পুলওয়ামা-কাণ্ড ভারতকে যেমন অনড় রেখেছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ তেমন পাকিস্তানকে। বিলাওয়ালের নজিরবিহীন আক্রমণ এবং হালে পুঞ্চ হামলায় পাঁচ জওয়ানের মৃত্যু ভারতের ক্ষোভের আগুনে ধুনো দিয়েছে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কাশ্মীরে ‘জি-২০’ পর্যটন সম্মেলন বানচাল করতে পাকিস্তান উঠেপড়ে লেগেছে। এ অবস্থায় বিলাওয়ালকে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য বেশি গুরুত্ব দিতেও ভারত রাজি নয়।

রাজি নয় বলেই ভারত নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, গোয়ায় বিলাওয়ালের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের পার্শ্ববৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। কেন নেই, সেই ব্যাখ্যা জয়শঙ্করই দিয়েছেন। পানামা সফরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা দুই দেশই এসসিওর সদস্য। ভারত এবার সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করছে। সবাইকে তাই প্রথামাফিক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে…সীমান্ত-সন্ত্রাস অব্যাহত রাখা কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে কথাবার্তা চালানো খুব কঠিন। আমরা বারবার বলেছি, যে প্রতিশ্রুতি ওরা দিয়েছে, তা পালন করুক। সন্ত্রাসে মদদ দেওয়া বন্ধ করুক। আশা করি, কোনো একদিন তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।’

পাকিস্তান নিয়ে ভারত যতটা সতর্ক, তার চেয়ে অনেক বেশি তটস্থ চীনকে নিয়ে। পাকিস্তানের দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা যত, তার বহুগুণ বেশি শঙ্কা চীনের দিক থেকে। লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ, চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ প্রায় সর্বত্র। লাদাখের গালওয়ানে কিংবা ভুটান সন্নিবিষ্ট ডোকলামে ভারতের পরীক্ষা চীন নিয়েছে। এখনো নিচ্ছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে ভারতকে সব সময় খুবই সতর্ক পদক্ষেপ রাখতে হয়। ওই দেশের কাকে কখন বিশ্বাস করা উচিত, তা বোঝা ভারতের পক্ষে সবচেয়ে কঠিন। ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্র এই অবিশ্বাসের কারণ। নওয়াজ শরিফকে বিশ্বাস করেছিল ভারত, ফল হয়েছিল কারগিল যুদ্ধ। পারভেজ মোশাররফ সেই কারণে বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

সম্প্রতি ইমরান খান দাবি করেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সেই ইমরান খানই আবার অভ্যন্তরীণ চাপে বাধ্য হয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে বন্ধ থাকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালু করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ (জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা) হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেন পাকিস্তান বন্ধ করে দেয়। এখন ভারতও বুঝতে পারছে না পাকিস্তানে এই সরকারের স্থায়িত্ব কত দিন।

পাকিস্তান নিয়ে নরেন্দ্র মোদির ভারতের অন্য আড়ষ্টতাও আছে। ঐতিহাসিক কারণে রয়েছে তীব্র স্পর্শকাতরতা। ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ তীব্র করেছে। তা করতে গিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের তারা সম্পৃক্ত করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে। বিজেপির বিচারে ভারতের মুসলমানরা ‘পাকিস্তানপন্থী’। পাকিস্তানের বিরোধিতা তাই ‘মুসলমানবিরোধিতা’। ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য এই ‘পাকিস্তান কার্ড’ বিজেপি খেলেই চলেছে।

পাকিস্তান নিয়ে ভারত যতটা সতর্ক, তার চেয়ে অনেক বেশি তটস্থ চীনকে নিয়ে। পাকিস্তানের দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা যত, তার বহুগুণ বেশি শঙ্কা চীনের দিক থেকে। লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ, চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ প্রায় সর্বত্র। লাদাখের গালওয়ানে কিংবা ভুটান সন্নিবিষ্ট ডোকলামে ভারতের পরীক্ষা চীন নিয়েছে। এখনো নিচ্ছে। এতগুলো বৈঠক সত্ত্বেও পূর্ব লাদাখের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থিতাবস্থা রক্ষায় ভারতের আরজিতে তারা কর্ণপাত করছে না। উল্টো অরুণাচল প্রদেশকে কেন্দ্র করে একের পর এক নতুন জিগির তুলে ধরছে। এত শত্রুতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের মতো চীনকে কিন্তু ভারত উপেক্ষা করতে পারছে না।

পাকিস্তানের মতো তাদের ‘একঘরে’ করতে পারেনি। এই বিপরীতধর্মী আচরণের একটি কারণ, চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি। অন্য কারণ, দেশজ রাজনীতি। চীনের বিরোধিতা আর যা-ই হোক, ধর্মীয় মেরুকরণের সহায়ক নয়। তাই এত টানাপোড়েন সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারত অব্যাহত রেখেছে। এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে আসা চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফুর সঙ্গে রাজনাথ সিং পার্শ্ববৈঠকও করেছেন। অথচ পাকিস্তান অচ্ছুত। বিলাওয়ালের সঙ্গে জয়শঙ্কর আলাদাভাবে মুখোমুখি বসছেন না!

পাকিস্তানের বর্তমান শাসক ঠিক কী করতে চাইছেন, ভারত সম্পর্কে তাঁর মনোভাবই-বা কেমন, ভারতও তা বুঝতে চাইছে। এসসিও বৈঠকে বিলাওয়াল ভারতে আসতে কেন রাজি হলেন, আর কেনইবা সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওয়াজা আসিফ আমন্ত্রিত হয়েও এলেন না, ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিলেন, এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সাউথ ব্লকের কাছে নেই। লি শাংফুর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসলেও রাজনাথ সিং করমর্দন করেননি।

বিলাওয়ালের সঙ্গে জয়শঙ্কর কী করবেন? ইমরান জমানার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ভারতমুখী বিলাওয়ালকে সতর্ক করে বলেছেন, কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের অধিকার ও কাশ্মীরিদের দুর্দশার কথা তিনি যেন ভুলে না যান। ভুলে না যান সে দেশের অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের কথা। বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিলাওয়ালের প্রথম ভারত সফরকে পাকিস্তানের ক্ষমতার বিভিন্ন উৎসমুখ আতশি কাচের তলায় মেলে ধরেছে। ভারত তো অবশ্যই।

বহুপক্ষীয় আসরকে কীভাবে দ্বিপক্ষীয় রঙে রাঙানো যায়, পাকিস্তানের তা জানা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বিলাওয়াল ব্যবহার করেন কি না, করলে কীভাবে; কাশ্মীর নিয়ে নতুন করে জল ঘোলা করেন কি না, কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে কী বার্তা দেন, ভারতের শ্যেন দৃষ্টি সেদিকেই।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি