মতামত

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা: আমরা কি শিশু ও জাতির কোনো ক্ষতি করছি

ভাষা শুধু যোগাযোগের জন্য নয়, শেখার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিকাশের একটি হাতিয়ারও বটে। একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, মাতৃভাষায় শিক্ষা শেখার ফল, একাডেমিক সাফল্য ও কৃতিত্বের একটি মূল কারণ। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জ্ঞানের ঘাটতি এড়াতে এবং শেখার ও বোঝার গতি বাড়াতে মাতৃভাষায় শিক্ষার অবদান অপরিহার্য।

অন্যদিকে গবেষণায় প্রচুর প্রমাণ দেখা গেছে যে, মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণকারী শিশুরা অসুবিধার সম্মুখীন হয়। শিক্ষায় মাতৃভাষার উপকারিতা এতটাই বেশি যে বিশ্বব্যাংক যখন ‘শিক্ষায় দারিদ্র্য’ পরিমাপ করে, তখন মাপকাঠি হলো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিশুদের কত শতাংশ একটি নির্দিষ্ট স্তরে পড়তে ও শিখতে পারে মাতৃভাষায়।

এ কথাই বিপরীতভাবে বলতে গেলে বলা যায়, শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষা যদি হয়, সেটা শিক্ষা ও শিশুর বিকাশে উপকারী প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হয়। ইউনেসকো এ কথা বিবেচনা করে জানিয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগের অভাব রয়েছে। এ কারণে তারা ভুক্তভোগী হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইউনেসকোর অনুমান, সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন (৪০ কোটি) শিশু এ কারণে সুবিধাবঞ্চিত। একই কারণে শেখার এ বাধা দূর করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে সম্ভব বিভিন্ন দেশ এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুদের এই প্রতিবন্ধকতার স্বীকৃতিস্বরূপ চাকমা, গারো ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে তাদের জন্য পাঠ্যক্রম অনুমোদিত করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করেছে।

বাংলাদেশে আমরা ভাগ্যবান যে বেশির ভাগ মানুষের মাতৃভাষা হলো বাংলা। বাংলা এমন একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা, যে ভাষায় সারা বিশ্বের ৩০০ মিলিয়নের (৩০ কোটি) বেশি মানুষ কথা বলে। তবু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব রয়েছে, সেটা হলো, বাংলাদেশে ইংরেজি একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষার মাধ্যম।

মাতৃভাষা বাংলা, অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি নিয়ে শিক্ষা পাচ্ছে—এ রকম কতজন বাংলাদেশি শিশু আছে, তার কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই। কিন্তু সংখ্যা যা–ই হোক না কেন, তাদের অভিভাবকেরা কি জানেন যে তাঁরা এই শিশুদের শেখার ও বিকাশের ক্ষেত্রে অসুবিধার মধ্যে ফেলছেন? বিষয়টি বাংলাদেশের সমাজ কি জানে?

কীভাবে আমরা এমন ক্ষতিকারক অসংগতির শিকার হলাম? আমাদের দেশে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক অতীতের উত্তরাধিকার রয়েছে। ব্রিটিশরা উপনিবেশ ভারতে ইংরেজি ভাষা চালু করেছিল উপনিবেশটিকে অ্যাংলোফোন এবং সম্ভবত অ্যাংলোফাইল করার স্পষ্ট অভিপ্রায়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কেবল আমাদের ওপর ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেয়নি, একটি বিশেষ ‘মানসিকতার’ও জন্ম দিয়েছে। এটা মারাত্মক। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পরও আমরা ইংরেজিকে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তৃতীয় স্তরসহ সব স্তরে বাংলাকে মাধ্যম করে শিক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আবেগঘন মুহূর্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমাজে এটি ছিল বিশেষ অশান্তির সময়, ছিন্নভিন্ন অবস্থার সময়। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থার এ বিপর্যয় জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ উদ্বেগ সৃষ্টি করে। সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বুদ্ধিজীবীরাও বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করে বাংলায় উপযুক্ত বইয়ের ঘাটতি দূর করতে তাদের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আসতে ব্যর্থ হন।

ইতিমধ্যে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি ইংরেজিতে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ প্রবণতা দ্রুত কিন্ডারগার্টেন স্তর থেকে শুরু করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিস্তারের দিকে চলে যায়। দেশে একটি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা চালু হচ্ছে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করে—সরকার এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, প্রতিকার করা তো দূরে থাক। বরং এটিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে দেয়। উচ্চবিত্ত ও সমাজের সুবিধাভোগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায়। এমনকি মধ্যবিত্ত অভিভাবকেরাও বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকে ছুটতে শুরু করেন। তাঁদের সন্তানদের এ ধরনের স্কুলে পাঠাতে যারপরনাই চেষ্টা করতে থাকেন, যদিও এসব তাঁদের সাধ্যের বাইরে।

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা পেয়ে ছেলেমেয়েদের কী হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে মা–বাবারা এই শিশুদের অনেক কষ্টে ফেলে দিচ্ছেন। তাদের এমন একটি ভাষার মাধ্যমে শিখতে বাধ্য করছেন, যা তাদের নিজস্ব নয়। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত শিশুদের একটি অংশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখতে পারে, কিন্তু শিক্ষার উৎকর্ষ এবং মেধা ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীই বঞ্চিত হতে পারে। এতে ভবিষ্যতের সুযোগের ব্যাপারে তারা বিপদে পড়তে পারে।

আরও দুঃখের কথা, সরকারই উদ্যোগ নিয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তকগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে শিক্ষার আরও একটি ধারাকে সংযোগ করে ‘ইংরেজি ব্যান্ডওয়াগন’-এ যোগ দেয়।

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার জন্য এত তাড়া কেন? এর যৌক্তিকতা কী? লাভ কী কী? ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার সুবিধা রয়েছে, সেটা স্বীকৃত, কিন্তু তার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করতে হবে, এ সমীকরণ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

একজন শিক্ষার্থী যদি বাংলায় শিক্ষা লাভ করে, তবু ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়া সম্পূর্ণরূপে সম্ভব। সত্য হলো, ইংরেজির সুবিধা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত নয়, এর প্রাথমিক সম্পর্ক হলো ইংরেজি জ্ঞানের সঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ইংরেজি চালু করা হয়েছে এবং তারপর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সাত বছর ইংরেজি শেখার পর শিক্ষার্থী তৃতীয় স্তরে ইংরেজি বই পড়ে বুঝতে পারবে। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থী তৃতীয় স্তরে শিক্ষা ইংরেজি মাধ্যমে করতে সক্ষম হবে। এটি অলীক কথা নয়। ষাটের দশকে এটা সত্য ছিল। আজ ইংরেজি শেখার অনেক বেশি সুযোগ থাকার কারণে ভাষায় পারদর্শী হওয়া সহজ। এত সুযোগ ও সুবিধা সত্ত্বেও কোনো যুবক-যুবতী ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হবেন না, এমন কোনো কারণ নেই।

আমাদের গভীরভাবে তলিয়ে দেখা উচিত, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা পেয়ে ছেলেমেয়েদের কী হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে মা–বাবারা এই শিশুদের অনেক কষ্টে ফেলে দিচ্ছেন। তাদের এমন একটি ভাষার মাধ্যমে শিখতে বাধ্য করছেন, যা তাদের নিজস্ব নয়। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত শিশুদের একটি অংশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখতে পারে, কিন্তু শিক্ষার উৎকর্ষ এবং মেধা ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীই বঞ্চিত হতে পারে। এতে ভবিষ্যতের সুযোগের ব্যাপারে তারা বিপদে পড়তে পারে।

আমরা যদি তৃতীয় স্তরের শিক্ষার দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের একটি বড় উপস্থিতি দেখতে পাই না। এটা সর্বজনসম্মত, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চতর শিক্ষার মান বজায় রাখে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পছন্দ করে, যেখানে ভর্তি পাওয়া সহজ এবং উচ্চ গ্রেডের জন্য প্রতিযোগিতা কম।

আরও একটি বড় সমস্যা—ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বেশি, অথচ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির অভিভাবকেরা এসব প্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের পড়াচ্ছেন। ফলে তাঁরা আর্থিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে ইংরেজিতে দক্ষতা গুলিয়ে ফেলে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তান ও জাতির ক্ষতি করছেন; এমনকি মধ্য ও নিম্নবিত্ত অভিভাবকেরা তাঁদের নিজেদের ও পরিবারের ক্ষতি করছেন।

  • জসিমউজ জামান ও মতিলাল পাল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত এবং ‘গ্রামীণ বাংলাদেশে টেকসই মানসম্পন্ন শিক্ষা: স্বপ্ন থেকে বাস্তবে’ বইয়ের সহলেখক।