ঢাকায় বিশুদ্ধ বাতাসের ব্যবসা কবে শুরু হবে

‘আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু আট বছর কমছে।’
ফাইল ছবি

নতুন বছরের প্রথম দিনই ছিল ঢাকার জন্য অশনিসংকেত। নতুন সূর্য, নতুন ভোর। দিনের শুরুতেই জানা গেল, ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর। পরের দিন সেটি আরও বেশি। এভাবে আমরা দেখতে পেলাম ‘ভয়ংকর’ জানুয়ারি মাস। দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে বারবার ঢাকার নাম ‘উজ্জ্বল’ হয়ে উঠল! গত সপ্তাহে সাত দিনের ছয় দিনই দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৪ দিনের ২৩ দিনই রাজধানী শহরের বাতাস এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে একে বিপজ্জনক বলা হচ্ছে।

এখন বিষয়গুলো আমাদের জানতে হয় পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম দেখে। কয়জনই–বা ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) বা বায়ুর মান পরখ করে দেখা, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটি সম্ভবও না। একইভাবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের তালিকাও দেখা হয় না। এ প্রতিষ্ঠানই মূলত দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির নাম বলতে পারবে এই প্রায় দুই কোটি মানুষের জনসংখ্যার শহরের গুটিকয় মানুষই।

বায়ুদূষণে ঢাকা কতটা বিপর্যস্ত, সেটি বোঝা যায় কয়েক দিন এ শহরে না থাকলে। যাঁরা রাজধানীর বাসিন্দা নন, তাঁরা কোনো কাজে এ শহরে এলে প্রয়োজন শেষ হতেই যে ঢাকা ছাড় চান, সেটি আমাদের কারও অজানা নয়। আর যাঁরা ঢাকার বাসিন্দা, স্থায়ী বাসিন্দা হোন বা কর্মসূত্রে হোন, তাঁরা যখন কয়েক দিনের জন্য এ শহরের বাইরে যান, তখন নিশ্বাস নিতে কেমন লাগে? আবার ঢাকায় ফেরত আসতেই রীতিমতো একটি ধাক্কা খেতে হয়। তখনই বোঝা যায়, ঢাকার বাতাস কতটা খারাপ।

এখন ‘খারাপ বাতাস’ বলতে গ্রামগঞ্জের মুরব্বিরা অন্য কিছু বোঝান। কাউকে খারাপ বাতাসে পেয়েছে মানে তাদের কাছে, জিন-পরির আসর করা। কারও মাথা খারাপ হলে বা মানসিক সমস্যা দেখা দিলেই এমন মন্তব্য শোনা যায় তখন। অনেকে অবাক হতে পারেন, ঢাকার বাতাস আসলে দিন দিন সেই ‘খারাপ বাতাসেই’ পরিণত হচ্ছে। সেটি কী রকম?

প্রথম আলোর কিছু প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখলাম, বায়ুদূষণের সঙ্গে বিষণ্নতা ছাড়াও রাগ, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ, এমনকি আত্মহত্যারও সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারস্পেকটিভ একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাতাসে ভারী বস্তুকণা পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর পরিমাণ বেড়ে গেলে তা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ওই দুই ভারী বস্তুকণার সঙ্গে অন্যান্য ভারী ধাতুও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এসব বস্তু বাতাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে আসে। এতে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এ পরিস্থিতিতে মানুষ বিষণ্ন ও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।

এরপর ২০১৯ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকার প্রায় ১২ হাজার ৫০০ মানুষের ওপর একটি সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। সেখানে বেরিয়ে আসে এ শহরের ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে অসুস্থ। আর মোট জনগোষ্ঠীর ৪৪ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছে। এই অসুস্থা ও বিষণ্নতায় ভোগার পেছনে বায়ুদূষণ একটি প্রভাব হিসেবে কাজ করছে সেখানে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রকার দূষণের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয় বায়ুদূষণকে। সেটিই হওয়া স্বাভাবিক! ‘খারাপ বাতাস’ পয়দাকারী কারণগুলো দেখলেই সেটি বোঝা যায়। প্রতিটির পেছনেই কোনো না কোনো না কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আছে। এখন ভাবুন তো দফার পর দফা মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়া একটি বিআরটি প্রকল্প বা একটি মেট্রোরেল প্রকল্প কী পরিমাণ বায়ুদূষণ তৈরি করছে এবং এর কারণে কত মানুষ নীরবে মারা যাচ্ছে। এ হচ্ছে উন্নয়নের তেলেসমাতি!

গত বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ারপলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। দূষিত এলাকাগুলোর মধ্যে ডিপ্রেশনের রোগী দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত দূষণের মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে ডিপ্রেশনের সম্ভাবনা ২০ গুণ বেড়ে যায়।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণাটি বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ মারা যান। শুধু বায়ুদূষণের কারণে এত বিপুলসংখ্যক মৃত্যু, আমাদের কোনোভাবেই স্পর্শ করছে না! না করারই কথা। কারণ, মৃত্যুগুলো হয় স্লো পয়জনিংয়ের মতো। বিষক্রিয়ায় যেমন মানুষ ধীরে ধীরে মরে, বিষাক্ত বায়ুও আমাদের মারছে সেভাবে। দেশে যত মানুষ যক্ষ্মা ও এইডসের মতো রোগে মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে দূষিত বায়ুর কারণেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূষিত বায়ুর কারণে মূলত ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটে। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগের সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিডনি ও চোখের সমস্যাও হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের হার বাড়ে।’

বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে ২০১৬ সালে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খানের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর ছয়টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করা হয়। সেই জরিপে উঠে আসে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে। এ কয় বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার কথা। এ নিয়ে নতুন কোনো গবেষণা চোখে পড়েনি।

স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু আট বছর কমছে।’ গত ১৭ জানুয়ারিও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সংসদে তাঁর এক বক্তব্য শিকার করেছেন, দেশে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুহার বাড়ছে। তবে বায়ুদূষণ রোধে সরকারের নেওয়া যেসব পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন, তার সুফল কতটা, সেটি তো আমরা দেখতে পাচ্ছি!

পরিকল্পনা ও উন্নয়ন গবেষণা এবং নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বায়ুমানের এমন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বলছে, রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, ইটভাটা, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো—মূলত এসব মিলে ঢাকা শহরের বাতাস বিপজ্জনক করে তুলেছে।

দুঃখজনক হচ্ছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রকার দূষণের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয় বায়ুদূষণকে। সেটিই হওয়া স্বাভাবিক! ‘খারাপ বাতাস’ পয়দাকারী কারণগুলো দেখলেই সেটি বোঝা যায়। প্রতিটির পেছনেই কোনো না কোনো না কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আছে। যখন যে সরকারই থাকুক না কেন, ‘দূষিত রাজনীতির’ সব চেয়ে সফল সুফলভোগী এসব গোষ্ঠী। এখন ভাবুন তো দফার পর দফা মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়া একটি বিআরটি প্রকল্প বা একটি মেট্রোরেল প্রকল্প কী পরিমাণ বায়ুদূষণ তৈরি করছে এবং এর কারণে কত মানুষ নীরবে মারা যাচ্ছে। এ হচ্ছে উন্নয়নের তেলেসমাতি!

পরিবেশমন্ত্রী গত ৩১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে একটি মজার তথ্য দিলেন, দেশের ইটভাটার ৬০ শতাংশই অবৈধ এবং এসব ইটভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এটি মজার তথ্য এ জন্য, বিষয়টি জেনেও তারা, মানে সরকার কিছু করছে না, কিছু করবেও না।

ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হবে না। মূলত, সরকার এটি চায় কি না, সেটিই হলো বড় কথা।

প্রথম আলোর যে খবর ধরে মূলত এ লেখার অবতারণা, সেটি হলো বছরে ৩১৭ দিন মারাত্মক দূষিত থাকে ঢাকার বায়ু। তার মানে ৪৮ দিন ছাড়া গোটা বছরই রাজধানী শহরের বাতাস থাকে অস্বাস্থ্যকর, কোনো কোনো সময় সেটি বিপজ্জনক। কী ভয়াবহ ব্যাপার। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের নগর, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মাসে ঢাকার বায়ুর মান যতটা খারাপ হয়েছে, তা বিশ্বের উন্নত অন্য দেশগুলোয় হলে সেখানে বিশেষ সতর্ক অবস্থা জারি করা হতো।

এমন খবর ও বক্তব্যে আমাদের অনেকের হয়তো একটি দৃশ্যই মনে আসছে, ঢাকার রাস্তায় মানুষ অক্সিজেন মাস্ক বা সিলিন্ডার নিয়ে চলাচল করছে। বিষয়টা কল্পবিজ্ঞানের দৃশ্য হলেও, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেচে তা না ভেবে কি উপায় আছে? এখনো ঘরের বাইরে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত আমরা। দিল্লি বা বেইজিংয়ের মতো ঘরের ভেতরেও ঢুকে পড়েনি। সেটির কি বেশি দিন দেরি আছে আসলে? তখন তো বোতলে ভরে অক্সিজেন কিনে আমাদের শ্বাস নিতে হবে। বেইজিং ও দিল্লিতে ইতিমধ্যে সেটি শুরুও হয়ে গেছে। বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাসের ব্যবসার পসরা বসে গেছে। তখন বায়ুদূষণ জিইয়ে রাখা সেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে এ বিশুদ্ধ বায়ুর ব্যবসা দখলে নিতে দেখলে আমরা অবাক হব না।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী