ভ্লাদিমির পুতিনের পুনর্নির্বাচন ক্যাম্পেইনে অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যু কী প্রভাব রাখতে পারে? কারও কারও মতে, এটাও একটা অগ্রগতি। অবশ্যই নেতিবাচক এবং পুতিনের বিপক্ষে। এ দলের সদস্যরা মূলত ক্রেমলিনের রাজনৈতিক শিবিরভুক্ত। কিন্তু পুতিন প্রশাসনের সদস্যরা মনে করেন, এ মৃত্যুর গুরুতর কোনো প্রভাব নেই।
উল্লেখ্য, আগামী মাসে রাশিয়ায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পুতিন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ দুই সূত্রের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তাঁদের একজন ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত এবং অপরজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। (পুতিনের পুনর্নির্বাচিত হয়ে আসায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকলে কেউই আর নাম প্রকাশ করতে চান না আজকাল)।
নাভালনির মৃত্যুর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে এ দুই সূত্র খুবই নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ২০২১ সালে রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তনের পর নাভালনি কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তা তাঁরা জানতেন। তাঁর শাস্তি হয় ‘দেশবিরোধী’ কাজের অভিযোগে।
দুজনেই মনে করেন, নাভালনিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের অব্যবস্থাপনার যে কথা তোলা হচ্ছে, তা অজুহাত ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাঁদের একজন বলেছেন, ‘আপনারা কি অন্য কিছু আশা করেছিলেন? এটা ঘটতই, আগে বা পরে।’
নাভালনির মৃত্যুর পর তাঁকে দুভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে, কারও কাছে তিনি নিন্দিতও।
এর আগে রাসায়নিক প্রয়োগে নাভালনির স্নায়ু বিকল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল রুশ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির রূপান্তরিত নাম) বা এফএসবির লোকজন। জার্মানিতে চিকিৎসা শেষে নাভালনি স্বেচ্ছায় রাশিয়ায় ফিরে আসেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। তখন থেকেই তিনি কারাগারে। মৃত্যুর সময় তিনি ১৯ বছরের সাজা খাটছিলেন একটি বিশেষ বন্দিশালায়। কারাগারটির অবস্থান আর্কটিকের উত্তরে রাশিয়ার ইয়ামালো নেনেতস অটোনমাস অকুর্গে।
১৬ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার কারা কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক আরেকটি দাবি করেছে, নাভালনির মৃত্যু হয়েছে রক্ত জমাট বেঁধে। কিন্তু আমরা নাভালনির স্বজনদের বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়েছেন, এমন একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর যে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তা সম্ভবত সত্য নয়। একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ময়নাতদন্ত ছাড়া নাভালনির মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
নাভালনির মৃত্যুতে বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ সভা হবে না বলে মনে হয়। রুশ কর্তৃপক্ষ বহু আগে রাস্তায় সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ এখন ধূসর। আমাদের ভবিষ্যৎ যে বৃন্ত আঁকড়ে ধরেছিল, যিনি কারও মনে আশা, আর কারও মনে ভীতি জাগিয়েছিলেন, সেই বৃন্ত ছিঁড়ে গেছে। তিনি চিরদিনের জন্য নেই হয়ে গেছেন। গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার যে সম্ভাবনা, তারও কোনো অস্তিত্ব আর থাকল না এবং ভবিষ্যৎ কী, কেউ তা জানে না।
অনেক বিশ্লেষক ও জনবুদ্ধিজীবীরা বলছেন, এই মৃত্যুকে হত্যা বলে গণ্য করা উচিত। এ জন্য পুতিন দায়ী। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ অপর দুই সূত্র নাভালনির মৃত্যুতে তাঁদের বেদনার কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁরা নাভালনিকে ‘নিন্দিত ব্যক্তিত্ব’ বলে মনে করেন। আর বলেন, ‘নিন্দিত’ ব্যক্তিত্বও এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারেন না।
নাভালনিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৭তম বারের মতো একটি একক প্রকোষ্ঠে আটকে রাখার ঘটনা ঘটে। নাভালনির সমর্থকেরা তাঁর স্বাস্থ্য এবং কারাগারে তাঁর প্রাণহানি হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছিলেন। এমনকি চিকিৎসকেরাও জানিয়েছিলেন সে কথা। ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, তাঁদের কাছে সুনিশ্চিত তথ্য আছে যে নাভালনির মতো ব্যক্তিকে কারাগারে কীভাবে রাখা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে।
মেদুৎসা মনে করে, নাভালনির মৃত্যুর তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে পশ্চিমে। ফক্স নিউজের সাবেক উপস্থাপক টাকার কার্লসনের মাধ্যমে পশ্চিমা দর্শকের কাছে পৌঁছানোর যে চেষ্টা পুতিন করেছিলেন, তা ব্যর্থ হলো। একটি সূত্র বলেছে, প্রেসিডেন্ট একজন রক্তপিপাসু একনায়ক হিসেবেই চিত্রিত হবেন। পশ্চিমা দেশগুলো এ পরিস্থিতিতে কোনো আলোচনায় বসাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে। এখন আর কোনো সমঝোতার সুযোগ নেই। অপর একটি সূত্র আশঙ্কা করছেন, নাভালনির মৃত্যুর কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনার যে আভাস দেখা গিয়েছিল তা শেষ, পরিস্থিতি আরও জটিল হলো। অবশ্য কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলাপ পুতিন করতে চান না বলে দাবি করেছেন পুতিনের মুখপাত্র।
মেদুৎসা নাভালনির মৃত্যু নিয়ে যাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছে, তাঁদের ধারণা রাশিয়ার ভেতরে এই মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হবে না। প্রথম কয়েক দিন অল্পস্বল্প কথাবার্তা হবে, তারপর সব ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাবে। ২০২২ সালে ইউক্রেন দখলের পর নাভালনির বেশির ভাগ সমর্থককে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, এ কথা অনেকে নতুন করে স্মরণ করছেন।
রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র নাভালনির মৃত্যুর আলোচনা ধামাচাপা দিতে যা করার তা-ই করবে। ক্রেমলিন-সমর্থিত একটি সংবাদমাধ্যমের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি জানান, পুতিন প্রশাসনের কাছ থেকে তাঁরা নির্দেশনা পেয়ে গেছেন। ২০২০ সালে তাঁকে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর নাভালনিকে চরমপন্থী ও গুরুতর অপরাধের জন্য কারাবন্দী হিসেবে উল্লেখ করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে পরিবর্তনের যে আশা ছিল, নাভালনির মৃত্যুতে তারও মৃত্যু ঘটেছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ক্রেমলিনের রাজনৈতিক কৌশলবিদেরা মেদুৎসাকে জানিয়েছেন, নাভালনির মৃত্যুতে সরকারের ভূমিকা কী হবে, তা আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। যেহেতু ‘বিগ বসেরা’ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে তাঁরা কিছুতেই নাভালনিকে বেরোতে দেবেন না। ফলে কারাগারে কিছু একটা ঘটবে, এটা কারোরই অজানা ছিল না।
রাজনৈতিক একজন কৌশলবিদ আরও বলেছেন, নাভালনির মৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ও পুতিনপন্থী সংবাদমাধ্যম কী কী ভাষ্য উপস্থাপন করবে, তা-ও ঠিক করা আছে যেমন ‘একজন চরমপন্থী বিরোধীদলীয় ব্যক্তির রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যু নিয়ে পশ্চিমে হইচই চলছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য পুতিনের সম্মানহানি ও তাঁর ওপর দোষ চাপানো’, ‘নাভালনির মৃত্যু আমাদের জন্য লাভজনক কিছু নয়, বরং পশ্চিমারা এতে উপকৃত হলো। তারা তাদের এজেন্টকে উৎসর্গ করল’, ‘রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ও চরমপন্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাভালনিকে সরিয়ে দিয়েছে, যেন ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো সমঝোতা আর না হতে পারে।’
নাভালনির মৃত্যুতে বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ সভা হবে না বলে মনে হয়। রুশ কর্তৃপক্ষ বহু আগে রাস্তায় সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ এখন ধূসর। আমাদের ভবিষ্যৎ যে বৃন্ত আঁকড়ে ধরেছিল, যিনি কারও মনে আশা, আর কারও মনে ভীতি জাগিয়েছিলেন, সেই বৃন্ত ছিঁড়ে গেছে। তিনি চিরদিনের জন্য নেই হয়ে গেছেন। গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার যে সম্ভাবনা, তারও কোনো অস্তিত্ব আর থাকল না এবং ভবিষ্যৎ কী, কেউ তা জানে না।
● আন্দ্রে পার্ৎসেভ: রুশ সাংবাদিক