বেসরকারি চাকরিজীবীরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো কোনো পেনশন পান না। তাঁরা তাঁদের চাকরিজীবনে প্রতি মাসের বেতন থেকে কিছু টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্য তহবিলে রাখেন। এর সঙ্গে যোগ হয় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমপরিমাণ চাঁদা। কর্মীর নিজের ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ মিলে প্রভিডেন্ট ফান্ডে যে অর্থ জমা হয়, সেই টাকা ফেলে না রেখে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
এভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয় বাড়ে, যা অবসরের সময় বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। কর আহরণ বাড়াতে মরিয়া হয়ে সরকার সম্প্রতি বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের সামাজিক সুরক্ষার অবলম্বন এই প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর ধার্য করেছে, যদিও সরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডকে এই করপোরেট কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, নতুন আয়কর আইনে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড (ভবিষ্য তহবিল) ও গ্র্যাচুইটি ফান্ড (আনুতোষিক তহবিল)—উভয়ের ওপরই এই করপোরেট কর বসেছে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর করপোরেট কর বসায় বেসরকারি চাকরিজীবীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আর গ্র্যাচুইটি ফান্ডের ওপর করপোরেট কর বসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পরোক্ষভাবে। কারণ কর বাড়িয়ে দেওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাচুইটি ফান্ড বাবদ খরচ বাড়বে, ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান গ্র্যাচুইটি ফান্ড গঠনে নিরুৎসাহিত হতে পারে। (যাঁদের ভবিষ্য তহবিলের টাকা কমবে, প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
এর আগপর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাতের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ডকে সরাসরি কোনো আয়কর দিতে হতো না। তবে এসব ফান্ডের অর্থ সঞ্চয়পত্র বা এফডিআরে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ২০১৬ সাল থেকে খাতভেদে মুনাফার ওপর উৎসে কর হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর দিতে হতো।
নতুন আয়কর আইনে ট্রাস্ট ও তহবিলের আয়ের ওপর প্রতিবছর সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর বসানোয় এবং শুধু সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডকে কর অব্যাহতি প্রদান করায় বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডকে এই বিপুল কর প্রদান করতে হবে, যার ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা।
সরকারি পেনশন সুবিধার কারণে সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এমনিতেই বেসরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় এগিয়ে। এমনকি নতুন চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন ফান্ডে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণে তা সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের বিকল্প হতে পারছে না। এ রকম একটা অবস্থায়, শুধু বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর কর আরোপের কারণে এই বৈষম্য আরও বেড়ে গেল।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্য তহবিলের মতো সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের আয়ের ওপর করপোরেট কর আরোপ কতটা যুক্তিযুক্ত? এই ভবিষ্য তহবিলের সুবিধাভোগী কি কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান নাকি সাধারণ বেসরকারি চাকরিজীবী?
আবার সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিলকে করের আওতামুক্ত রেখে বাড়তি সুবিধা প্রদান করা হলো। সরকারি পেনশন সুবিধার কারণে সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এমনিতেই বেসরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় এগিয়ে। এমনকি নতুন চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন ফান্ডে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণে তা সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের বিকল্প হতে পারছে না। এ রকম একটা অবস্থায়, শুধু বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর কর আরোপের কারণে এই বৈষম্য আরও বেড়ে গেল।
কিন্তু সরকারের কাছে কি কর বাড়ানোর আর কোনো উপায় ছিল না যে বেসরকারি চাকরিজীবীদের শেষ অবলম্বনের আয়ে হাত দিতে হলো? সন্দেহ নেই, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় কর আহরণ হয় কম।
বর্তমানে বাংলাদেশে কর জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা অন্তত ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই নিম্ন কর জিডিপি অনুপাতের কারণ কি এই যে, সাধারণ মানুষ কর কম দেয়, নাকি সরকার ধনীদের কাছ থেকে যথেষ্ট কর আহরণ করতে পারছে না বা করছে না?
পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, সরকার সারা বছর যত কর আদায় করে, তার বেশির ভাগটাই আসে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে—শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর থেকে। সরকার যে ধনীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আহরণ করে না, তার প্রমাণ হলো, সরকারের কর-রাজস্ব আয়ের ৬৫ থেকে ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর থেকে আসে, যা কোনো পণ্য ও সেবা কেনার সময় সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হয়।
বাকি অংশ আসে প্রত্যক্ষ বা আয়কর থেকে। অথচ উন্নত দেশগুলোতে মোট রাজস্বের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৫০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ কর থেকে সংগ্রহ করা হয়।
অথচ বেসরকারি সংস্থা সিপিডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকার যদি ধনী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারে, তাহলে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে পারত, যা টাকার অঙ্কে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের আট গুণ; আর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দুই গুণ।
সরকার সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে করের চাপ বাড়াচ্ছে কেবল সাধারণ মানুষের ওপর। এমনকি প্রত্যক্ষ কর আদায়ের চাপও ধনী ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বদলে সাধারণ মানুষের ওপরই বাড়ানো হচ্ছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিলের আয় থেকে সন্তর্পণে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা।
একটি কল্যাণমূলক করব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো, আয় অনুযায়ী করারোপ। যাঁদের আয় কম, তাঁদের কাছ থেকে বেশি কর আরোপ কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিলের আয়ের ওপর করপোরেট করারোপের কারণে এমন অনেক চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয় থেকে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর কেটে নেওয়া হবে, যাঁদের হয়তো ১০ শতাংশ কর দেওয়ার মতো বার্ষিক আয়ও নেই! এই বৈষম্যমূলক কর অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
kallol_mustafa@yahoo.com