যাত্রীতে গিজগিজ করা আদ্রিয়ানা নামের ফিশিং ট্রলারটি গত ৯ জুন লিবিয়া উপকূল ছাড়ার আগমুহূর্তে সাজ্জাদ ইউসুফ তাঁর আব্বাকে ফোন করেছিলেন। সাজ্জাদের বাড়ির লোকজন তাঁকে পাকিস্তান থেকে বিপজ্জনক এই পথে ইউরোপে পাড়ি না জমাতে বহু অনুনয় করেছিলেন। কিন্তু ইউসুফ তা কানে তোলেননি। তিনি পাকিস্তানের অসহ্য বেকারজীবন ছেড়ে বহু বহু দূরে কোথাও পালাতে চেয়েছিলেন।
এই সমুদ্রযাত্রা যে অতি ভয়ংকর, তা সাজ্জাদ জানতেন। তবু তাঁর পীড়াপীড়িতে সেই ট্রলারে একটু জায়গা পাইয়ে দিতে তাঁর পরিবার ১০ লাখ রুপির বেশি কর্জ করে তাঁকে দিয়েছিল। ট্রলারটিতে থাকা সাড়ে সাত শ যাত্রীর বেশির ভাগই ছিলেন পাকিস্তানি। তাঁরা সবাই অভিবাসনপ্রত্যাশী। তাঁরা শুধু যে দারিদ্র্য ঘোচাতে ও ভাগ্যান্বেষণে এই বিপৎসংকুল যাত্রায় যোগ দিয়েছেন তা নয়, বরং তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেরও বলি। কারণ, এই প্রভাব তীব্রভাবে পাকিস্তানকে জেরবার করে ফেলছে।
জীবনবাজি রেখে যাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাচ্ছেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে বন্যা, খরা, হিমবাহ গলন, ফসলহানি ও পঙ্গপালের হানাসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবগুলোই পাকিস্তান ভোগ করেছে। আসলে দুর্যোগের পর দুর্যোগ সহ্য করাই পাকিস্তানের নিষ্ঠুর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় এটিকে ‘খোদায়ি গজব’ বলা হতো। এখন তা জাগতিক ও দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানিরা তাঁদের প্রাণঘাতী সমুদ্রযাত্রা আফগান, সিরিয়ান ও ফিলিস্তিনিদের মতো উপেক্ষিত বিশ্বের নারী-পুরুষের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন।
আদ্রিয়ানা নামের ট্রলারটি বিক্ষুব্ধ দরিয়ার মাঝে উদ্ধারকর্মীদের আসার অপেক্ষায় ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাসছিল। কিন্তু কেউ তাঁদের বাঁচাতে আসেনি। কর্তৃপক্ষগুলো কিছুই করেনি। গ্রিসের কোস্টগার্ডরা বলছেন, তঁারা ট্রলারটিকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যাত্রীরা নাকি সহায়তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৭৫০ যাত্রীর মধ্যে বড়জোর ১০০ জন বেঁচেছেন। বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে কোনো নারী ও শিশু আছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
মনে রাখা দরকার, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার যে অর্ধেক লোক দরিদ্রতম, তাদের নিঃসরণ করা মোট পরিমাণ কার্বনের দ্বিগুণ কার্বন নিঃসরণ করে অতিধনী ১ শতাংশ মানুষ। অবশ্যই সেই সেই ধনীরা ১.৫ শতাংশ কর দিতে সক্ষম। তাঁরা ৫ শতাংশ, এমনকি ১০ শতাংশ করও দিতে পারেন। বেসরকারি খাত থেকে সীমাহীন অর্থ আসতে পারে। সরকারি কোষাগারেও অর্থ আছে। তা সত্ত্বেও চলতি সপ্তাহে আমাদের বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তারা যে ১ হাজার ১৬০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে আসার পরিকল্পনা করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট সবখানে ও সবকিছুতে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। এই ক্ষরণ সামনে আরও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংকট যত বেশি দেখা দেবে, তত বেশি যুদ্ধ লাগার আশঙ্কা বাড়বে। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের ভাষ্যমতে, বিশ্বে যুদ্ধের কারণে যত লোক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তার চেয়ে ৩ থেকে ১০ গুণের বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। জাতিসংঘের ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান সিকিউরিটির হিসাবমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু–সংকটজনিত অভিবাসীর সংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছে যেতে পারে।
নেপালভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত হিন্দুকুশের হিমবাহ বিগত দশকের তুলনায় ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ৬৫ শতাংশ বেশি দ্রুততায় গলেছে। হিমবাহের এই অতিগলন ভাটির দিকে থাকা জনপদের ২০০ কোটি মানুষের জীবনকে বিপদের মুখে ফেলে দেবে। অন্যদিকে কাতালুনিয়া অঞ্চলজুড়ে ৩২ মাস ধরে চলা তীব্র খরায় বার্সেলোনার জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও এল নিনোর (এল নিনো হচ্ছে সাগরের উপরিভাগের পানির গড় মানের তাপমাত্রার পরিবর্তন। মূলত পূর্ব-মধ্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শান্ত সমুদ্রের পানির গড় তাপমাত্রা যখন কমপক্ষে ০.৫ সেলসিয়াস হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে এবং পাঁচ মাস বা তারও অধিক সময় ধরে সে অবস্থা চলতে থাকে, তখন এটিকে এল নিনো বলে।) প্রত্যাবর্তনের সুবাদে চলতি বছরটি উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করতে যাচ্ছে।
এটি নিশ্চিতভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একাংশকে উষ্ণ করে তুলবে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রাকেও বাড়িয়ে দেবে। পূর্বাভাসদাতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এল নিনো পরিস্থিতি চলতে থাকবে এবং আগামী বছরে তা আরও জোরালো হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও এল নিনোর সংমিশ্রণে সাইবেরিয়ায় রেকর্ড মাত্রার তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে। সেখানে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠেছে। স্পেন ও কানাডায় অকল্পনীয় তাপদাহের কারণে নজিরবিহীন দাবানল দেখা গেছে। কানাডার দাবানলের কারণে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের আকাশকেও গোলাপি বর্ণে দেখা গেছে।
আমরা এমনই এক ভবিষ্যৎ তৈরি করে রেখে যাচ্ছি। সুতরাং যখন প্রাইভেট জেটে চড়ে কোনো সেলিব্রিটি ও ফুটবলার সেলফি তোলেন, তখন তাঁর নাম মনের মধ্যে গেঁথে রাখুন। তাঁরা কিন্তু আধুনিক রোম পোড়ার মুহূর্তে নির্বিকার থাকা নিরো নন; তাঁরা পরিষ্কারভাবে দেশলাই হাতে অগ্নিসংযোগকারী। যখন বিগ অয়েল (বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছয়টি জ্বালানি কোম্পানির সম্মিলিত সত্তাকে ‘বিগ অয়েল’ বলা হয়ে থাকে) খুব ডাঁটের সঙ্গে বলে, তারা দ্বিগুণ অর্থ লাভ করেছে, তখন সেই লাভের অঙ্ক মনে রাখুন। কারণ, এই তেল কোম্পানিগুলো মুনাফার জন্য শুধু আমাদের এই আবাস ধ্বংস করছে না, তারা তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে নিঃশেষ হওয়া মানুষকে কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না।
আমরা পরিবেশ রক্ষার কথা মনে করে যত খুশি মন চায় প্লাস্টিক স্ট্রর বদলে কাগজের স্ট্র ব্যবহার করতে পারি; নবায়নযোগ্য পণ্য ব্যবহার করতে পারি এবং ইলেকট্রিক ট্রেনে চড়তে পারি; কিন্তু সত্যটা হলো, যতক্ষণ না তেল কোম্পানিগুলোর সিইওদের কর্মকাণ্ড পরিবর্তন করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই গ্রহকে রক্ষার লড়াই শুরুই করতে পারব না।
দ্য ক্লাইমেট অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। প্যারিস জলবায়ু অর্থসংক্রান্ত আলোচনা সামনে রেখে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ১০০ জন অর্থনীতিবিদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ করতে একটি চিঠি দিয়ে বিশ্বের অতি ধনীদের ওপর কর আরোপ করতে বলেছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরদের সম্পদের ওপর যদি বছরে ২ শতাংশ কর ধরা হয়, তাহলে আড়াই লাখ কোটি ডলার উঠবে। তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দরিদ্রতম দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া যেতে পারে, যদিও তা কোনো অর্থেই যথেষ্ট নয়।
মনে রাখা দরকার, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার যে অর্ধেক লোক দরিদ্রতম, তাদের নিঃসরণ করা মোট পরিমাণ কার্বনের দ্বিগুণ কার্বন নিঃসরণ করে অতিধনী ১ শতাংশ মানুষ। অবশ্যই সেই সেই ধনীরা ১.৫ শতাংশ কর দিতে সক্ষম। তাঁরা ৫ শতাংশ, এমনকি ১০ শতাংশ করও দিতে পারেন। বেসরকারি খাত থেকে সীমাহীন অর্থ আসতে পারে। সরকারি কোষাগারেও অর্থ আছে। তা সত্ত্বেও চলতি সপ্তাহে আমাদের বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তারা যে ১ হাজার ১৬০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে আসার পরিকল্পনা করছে।
অর্থাৎ আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ তৈরি করছি, যেখানে বিপর্যয় ছাড়া কিছু থাকছে না।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
● ফাতিমা ভুট্টো পাকিস্তানি লেখক ও গবেষক। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি