খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে দেশের এক–চতুর্থাংশ পরিবার। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ বেশি ঋণ করছেন। আর এ ঋণের বড় অংশই নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে, চড়া সুদে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩’–এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বরাতে এমন তথ্যই দেওয়া হয়েছে ১৯ মার্চ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে।
‘মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে ২৬% পরিবার’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত অর্থ বা অন্যান্য সম্পদের অভাবে খাদ্য গ্রহণ বা খাওয়ার ধরনে বিঘ্ন হলে তাকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিবিএসের ভাষ্যমতে, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়। আর্থসামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এ বিষয় কখনো জীবন–হুমকিরও কারণ হতে পারে। বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ পরিবার তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
আর মাঝারি বা তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে ২২ শতাংশ পরিবার।
এ সংবাদ প্রকাশের পরদিন ২০ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। ফি বছর এই দিবসের প্রাক্কালে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। যেখানে ‘সুখ’-এর নিরিখে দেশগুলোকে ক্রম অনুসারে তালিকায় সাজানো হয়; ক্রমে তা ‘অ-সুখ’-এর দিকে গড়াতে থাকে।
১৪৩টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০২৪ সালের করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম, গত বছর যা ছিল ১১৮।
সে হিসাবে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১ ধাপ পিছিয়েছে। যদিও গত বছর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ১৩৭টি দেশকে আমলে নেওয়া হয়েছিল। আর তার আগের বছর, ২০২২ সালের তালিকায় ৯৪ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ পর পর দুই বছর বাংলাদেশ ‘অ-সুখের’ দিক গড়িয়েছে, গতবার ২৪ ধাপ, এবার ১১ ধাপ।
রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. সামসুল হক অবশ্য জানেন না, ‘সুখ সূচক’ বস্তুটা কী।
সুতরাং বাংলাদেশ কতটা এগোল না, পা পিছলে পড়ে পিছিয়ে গেল, তা তাঁর অজানা। তবে তিনি যা বললেন, তাতে তাঁর ব্যক্তিগত ‘অ-সুখের’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাঁর ভাষ্যে, তাঁর আয় বরং কমেছে।
তাঁর বেতনে প্রতিবছর বাড়ে না, আর যা পান তা চলার মতো না। আগে তাও মাসে কিছু টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন, এখন জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে সংসার চালাতেই হিমশিম দশা।
সামসুল হকের কথায় আরেকটা বিষয়ও স্পষ্ট, ‘সুখ’ তাঁর কাছে আসলে মোটাদাগে ‘ভালো থাকা’; ভাত-কাপড়-মাথা গোজার ঠাঁই।
‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা সুখী কি না। পাশাপাশি সমীক্ষাধীন দেশগুলোর আর্থিক প্রবৃদ্ধি, গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় আমলে নেওয়া হয়।
এসব দাড়িপাল্লায় মেপে কী করে ‘সুখ’-এর মতো একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কীভাবে ‘সাকার’ দেওয়া হয়, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে বৈকি।
তবে এখানে মূল ভূমিকা থাকে ‘সংখ্যাতত্ত্ব’। ‘সুখ’-এর মাপকাঠি ঠিক করতে সমীক্ষায় এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়, যেগুলো আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কম জনসংখ্যার নর্ডিক দেশগুলো কিংবা বেশি জিডিপির দেশগুলোর সুখী দেশের তালিকার ওপরের দিকে থাকার বিষয়টি সে কথাই ঘোষণা করে।
কিন্তু যেন খোলামকুচির মতো আড়ালে পড়ে থাকে পরিবার-স্বজন, সম্পর্ক, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা বা যৌনতার মতো বিষয়গুলো।
যে প্রশ্নের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা যায় না, এমন একটি প্রশ্ন হলো সামসুল হকের মতো মানুষেরা এসব নিয়ে কতটা ভাবেন? কিংবা প্রশ্নটিতে ঘুরিয়ে এভাবেও করা যায়— ভাত-কাপড় জোটানোর যুদ্ধে তাঁরা আদৌ আর কিছু ভাবার সময় পান কি না।
মৌলিক চাহিদা মেটাতেই যে দেশের ২৫ শতাংশ মানুষকে ঋণ করতে হয়, সেই দেশ বা এরকম অন্য দেশগুলো যে সুখী দেশের তালিকায় ওপরের দিকে যে উঠবে না, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।
একই কথা খাটে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা কিংবা যুদ্ধের কবলে পড়া বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
শরিকি যাত্রা (রাইড শেয়ারিং) পরিষেবায় যুক্ত মোটরসাইকেলচালক সুমন হোসেনও জানেন না, সুখ পরিমাপের কথা। গাড়ি মেরামতির দোকান ছিল তাঁর, করোনা অতিমারির সময় তা বন্ধ হয়ে যায়।
শরিকি যাত্রা (রাইড শেয়ারিং) পরিষেবায় যুক্ত মোটরসাইকেলচালক সুমন হোসেনও জানেন না, সুখ পরিমাপের কথা। গাড়ি মেরামতির দোকান ছিল তাঁর, করোনা অতিমারির সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। সুমন বললেন, ‘কাম করি ভাত খাই, আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নাই!’ সুমন কি প্রকান্তরে এই কথাই বললেন না, ‘টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না।’
সুমন বললেন, ‘কাম করি ভাত খাই, আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নাই!’ সুমন কি প্রকান্তরে এই কথাই বললেন না, ‘টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না।’
যে কথাটি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের এক সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ওই সমীক্ষার ফল বলছে, সুখ নির্ভর করে সুস্বাস্থ্য, বন্ধুতার ওপর; অর্থের ওপর নয়।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাদুবলে যদি বিশ্বের গরিবি হঠাৎ হওয়া করেও দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের দুঃখ কমবে মাত্র ৫ শতাংশ, আর যদি বিষাদ ও উদ্বেগ উধাও করে দেওয়া যায়, তাহালে কমবে ২০ শতাংশ।
আড়াই শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয় ‘পারস্যু অব হ্যাপিনেস’ বা সুখের সন্ধানের অধিকার। ভেনেজুয়েলা কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মতো দেশে সুখবিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়।
এতে কি সুখ হাতের মুঠোয় ধরা দেয়? কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা যতক্ষণ না বলবৎ হবে, ততক্ষণ সুখের ওঠা–নামার একটা গ্রাফ পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু ‘অ–সুখ’ দূর হবে না।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com