মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উজ্জীবিত রাখতে স্বল্পমাত্রায় দুর্নীতির পক্ষে একবার ওকালতি করেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর এই বেফাঁস পরামর্শ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছে।
পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত একটা সমাজের অস্তিত্ব বাস্তবে হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থার করা বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণাসূচকে ফিনল্যান্ড কিংবা নরওয়ে যেখানে দুর্নীতি প্রতিরোধের দিক থেকে প্রথম কাতারে, সেখানে বাংলাদেশ কিংবা প্রতিবেশী মিয়ানমারের অবস্থান পেছনের দিক থেকে শীর্ষ দশে। এই তফাত নিশ্চিতভাবে গড়ে দেয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারব্যবস্থা। অর্থাৎ সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি অবস্থান নিচ্ছে, নাকি দুর্নীতি পেলেপুষে প্রতিপালন করছে।
গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির অভিজাত অংশে একটার পর একটা কেলেঙ্কারি যেভাবে অবমুক্ত হয়ে পড়ছে, সেটাকে আদৌ দুর্নীতির কোনো সংজ্ঞায় ধরা যায় কি? রাষ্ট্রীয় সংস্থার শীর্ষ পদে থেকে কিংবা জনপ্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে কীভাবে সম্পদের পাহাড় বানানো যায়, তারই একেকটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রথমেই আসা যাক তিনবারের জনপ্রতিনিধি আনোয়ারুল আজীমের প্রসঙ্গে। ভারতের সীমান্তলাগোয়া সংসদীয় আসন ঝিনাইদহ-৪-এর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিনবারের এই সংসদ সদস্য খুন হয়েছেন কলকাতায়।
প্রায় এক মাস পার হতে চললেও তাঁর লাশের সন্ধান মেলেনি। তাঁর রাজনৈতিক জার্নিটাকে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রের নীতি ও আদর্শহীনতার প্রতীক বলেই আমরা ধরে নিতে পারি।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আগে চরমপন্থী একটি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আজীমের। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক রং তিনি পাল্টে নিয়েছেন। জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপি হয়ে থিতু আওয়ামী লীগে। রাজনৈতিক ক্ষমতা আর হুন্ডি ব্যবসা–চোরাচালানের মতো অপরাধ কীভাবে একটি অপরটিকে গতি দিয়েছে, তারই দৃষ্টান্ত এই সংসদ সদস্য।
ডেইলি স্টার এর খবর বলছে, প্রতিটি সোনার বার চোরাচালানে ‘ট্যাক্স’ নিতেন এমপি আজিম। তদন্ত সংস্থার বরাতে সংবাদমাধ্যমটি জানাচ্ছে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সোনা চোরাচালান চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন এমপি আজিম।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এতটাই লোভী হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর এলাকা দিয়ে চোরাচালান হওয়া প্রতিটি সোনার বারের জন্য ‘ব্যক্তিগত ট্যাক্স’ নেওয়া শুরু করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত চোরাচালান চক্রের অন্য সদস্যদের ক্ষুব্ধ করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা আজিমকে ‘শেষ করে দেওয়ার’ পরিকল্পনা করে।
সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করে এই যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে দেশের নেংটি পরা কৃষক কিংবা কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষদেরই তাদের সম্বলটুকু নতুন জমিদারদের কৃষ্ণগহ্বরের মতো ঝুলিতে তুলে দিতে হচ্ছে। কিন্তু বেনজীর, আজীম কিংবা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্রের চার এমপি তো নতুন জমিদারদের আইসবার্গের চূড়ামাত্র, পুরো চিত্র নয়। এই অসংখ্য-অগুনতি নতুন জমিদারের সম্পদের অনন্ত ক্ষুধা মেটানোর মতো সম্পদ দেশের সাড়ে ষোলো কোটি ও প্রবাসে থাকা আরও সোয়া কোটি মানুষের কি আছে?
এমন ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যক্তি, যিনি কিনা পুরোপুরি বিপরীত মেরুর রাজনীতি করে এসে আওয়ামী লীগে থিতু হয়েছেন, তাঁকে কেন মনোনয়ন দেওয়া হলো?
এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, আনোয়ারুল আজীম জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সরকারি দলের কাছে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠিটা আসলে কী?
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মাঝেমধ্যে তাঁদের দলে অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড নেতাদের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়েন। এ ধরনের শব্দ হয়তো সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হিসেবে ভালো, পাঠককে আকর্ষণ করে। কিন্তু একটা দল যখন রাজনীতি, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র—সবকিছুকে ক্ষমতার স্বার্থে এক করে ফেলে, তখন তার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বলতে সত্যি কিছু বাকি থাকে কি?
নীতি-আদর্শকে সরিয়ে আনুগত্যই যেখানে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, সেখানে নানা দল-মতের সুযোগসন্ধানীরা এসে ভিড় করবে, সেটাই স্বাভাবিক। দলের সঙ্গে সুযোগসন্ধানীদের সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে স্রেফ লেনদেনের। সরকারি দলকে রক্ষা করা, বিনিময়ে যেমন খুশি তেমনভাবে সম্পদ বানানোর সুযোগ পেয়ে যাওয়া।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে লোক পাঠানো দ্বিদেশীয় চক্রের চারজন সংসদ সদস্যের কথাই ধরা যাক। মালয়েশিয়া যেতে যেখানে সরকারের নির্ধারিত ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা, সেখানে এই চক্রের কারণে সে ব্যয় বেড়ে হয়েছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
মালয়েশিয়ান চক্র ও দেশি চক্র—দুই সিন্ডিকেট মিলে দেড় বছরে সাড়ে চার লাখ তরুণের কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বাড়তি সাফল্য হিসাবে তারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পেরেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে অর্থনীতি যেখানে রীতিমতো ধুঁকছে, সেখানে বাংলাদেশিদের জন্য দ্বিতীয় বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া কত বড় সর্বনাশের ঘটনা! তার চেয়েও বড় সর্বনাশ ঘটে গেছে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি ভাগ্যান্বেষী তরুণের জীবনে।
ভিটেমাটি, সোনাদানা, জমিজিরাত বিক্রি করে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তরুণদের অনেকে ওই চক্রকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা করে দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। তাঁরা নিজেরা তো নিঃস্ব হলেনই, সেই সঙ্গে পরিবারগুলো স্থায়ীভাবে সংকটের মধ্যে ডুবে গেল।
২২ বছরের তরুণ তানভীর, যাঁর যাওয়ার কথা ছিল মালয়েশিয়া, ফেরানোর কথা ছিল পরিবারের ভাগ্য, কিন্তু তাঁর ঠাঁই হলো মেঘনা নদীর অতল তলে? রাষ্ট্র, সরকার, আমলাতন্ত্র, জনপ্রতিনিধি কেউ কি এই তরুণদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
অথচ এই সংকট তৈরির পেছনে সরকারের দায়টা ষোলো আনার মধ্যে ষোলো আনা। সাম্প্রতিক অঘটনের জন্য সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তই দায়ী। মালয়েশিয়া ১৫টি দেশ থেকে শ্রমশক্তি নেয়। এর মধ্যে ১৪টি দেশ থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এজেন্সি বাছাইয়ের শর্ত দেয়নি। ওই সব দেশের সব এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারে। আর বাংলাদেশ থেকে কিছু এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর জন্য বাছাই করে দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ এতে সায় দেয়। আর সে সুযোগটিই নিয়েছে দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে। এমপি জানি না, চিনি না, রিক্রুটিং এজেন্সি চিনি। দায়ী হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চক্র গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে; সেই চক্রকে সাধারণ মানুষেরর কাছ থেকে (যাঁরা দেশে বৈধ ও অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর তাঁদের পাঠানো সেই ডলার ওপরতলার লোকেরা পাচার করছেন) হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আবার সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিশ্রুতি কি ফাঁকা আওয়াজের মতো বড্ড বেশি কানে বাজে না?
সাধারণ মানুষের সম্পদ এভাবে ওপরতলার কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া এবং সেই সম্পদের বড় একটা অংশ পাচার হয়ে কানাডা, দুবাইয়ে বেগমপাড়া গড়ে তোলা- এই সমীকরণ কি বলছে, আমরা ২৪ বছরের ব্যবধানে দু-দুটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয়েছি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশপর্বে ঔপনিবেশিক প্রভুরা যে কৌশলে সম্পদের পাহাড় গড়তেন ও সেই সম্পদ পাচার করে দিতেন- তার থেকে ভিন্ন কিছু কি এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আজকের পত্রিকায় মঙ্গলবারের (৪ জুন, ২০২৪) প্রধান শিরোনাম ‘দেশজুড়ে বেনজীর আহমেদের জমিদারি’। ১০ জেলায় বেনজীর ও তার পরিবারের শুধু জমির পরিমাণ ২ হাজার ৩৮৫ বিঘা। আর এই জমির বড় একটা অংশ সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে জমি ‘কেনা’ হয়েছে।
সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করে এই যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে দেশের নেংটি পরা কৃষক কিংবা কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষদেরই তাদের সম্বলটুকু নতুন জমিদারদের কৃষ্ণগহ্বরের মতো ঝুলিতে তুলে দিতে হচ্ছে। কিন্তু বেনজীর, আজীম কিংবা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্রের চার এমপি তো নতুন জমিদারদের আইসবার্গের চূড়ামাত্র, পুরো চিত্র নয়। এই অসংখ্য-অগুনতি নতুন জমিদারের সম্পদের অনন্ত ক্ষুধা মেটানোর মতো সম্পদ দেশের সাড়ে ষোলো কোটি ও প্রবাসে থাকা আরও সোয়া কোটি মানুষের কি আছে?
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী