২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বোধ হয় ছিল আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য এযাবৎকালের সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বাজেট। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সরকারের দীর্ঘদিনের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩০ জুন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছিল যে এই কর অব্যাহতি সুবিধা আর বাড়ছে না, কারণ ছিল আইএমএফের চাপ। তিন মাস ধরে এই খাতের নেতারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির শুরু করেন।
অবশেষে আজ ঘোষিত বাজেটে এল সেই বহুল প্রত্যাশিত কর অব্যাহতি বৃদ্ধির ঘোষণা। আগামী তিন বছরের জন্য এই খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত থাকছে। এর জন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। বর্তমান সরকার সব সময় আমাদের আইসিটি খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
নানা কারণে এবার কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। প্রথমত, কোভিড-১৯–এর কারণে এই খাত ২টি বছর খুবই টালমাটাল অবস্থায় ছিল। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে এই খাত প্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি।
তার ওপর, ২০৪১ সাল নাগাদ সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে লক্ষ্য, তার পুরোটাই নির্ভর করছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ওপর। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, লজিস্টিক, স্বাস্থ্য সবকিছুই নির্ভর করছে এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাফল্যের ওপর। অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া মানে সবকিছুরই খরচ বেড়ে যাওয়া, যেটি সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়াবে স্মার্ট বাংলাদেশের বিনির্মাণের পথে।
আরেকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, এই খাত যেহেতু কোনো মর্টগেজ দিতে পারে না, সে জন্য এই সেক্টরকে কোনো ব্যাংক লোনও দেয় না। অর্থাৎ ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যে বিনিয়োগ দরকার, সেটিও কিন্তু আসে এই খাতের উপার্জিত লাভ থেকে। কর অব্যাহতি সুবিধা না বাড়ালে আজ হয়তো সেটিও বন্ধ হয়ে যেত।
এ বছর আইসিটির ১৯টি সাবসেক্টরকে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। গতানুগতিক প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে নতুনভাবে যোগ করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ডেটা অ্যানালিটিকসের মতো প্রযুক্তিগুলো। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যাত্রার পথে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি যেন ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে, সরকার সে ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক।
বাজেটে আরেকটি হতাশার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো। ভুলে গেলে চলবে না যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে মূল অক্সিজেনই হবে ইন্টারনেট। সরকারকে অনুরোধ করব, বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য।
তবে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে হোস্টিং সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের মতো খাতগুলো থেকে কর অব্যাহতির বিষয়টি তুলে নেওয়ায়। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বোঝার ঘাটতির জন্যই এমনটি হয়েছে।
যেমন হোস্টিং সার্ভিসের কথাই যদি ধরি; সরকার বরাবরই উৎসাহ দিচ্ছে দেশের ডেটা যেন দেশেই থাকে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা যদি অন্য কোনো দেশের হাতে থাকে, তাতে শুধু যে দেশের অর্থ অপচয় হবে তা–ই নয়, বরং দেশের নিরাপত্তার জন্যও বড় রকমের হুমকিস্বরূপ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দেশের হোস্টিং সার্ভিসের ৫৩ শতাংশ বাজার দখল করে আছে অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, ওরাকলের মতো টেক জায়ান্টগুলো। ৪০ শতাংশ বাচার দখল করে আছে দ্বিতীয় সারির কোম্পানি যেমন ডিজিটাল ওশান, মেইলচিপের মতো কোম্পানিগুলো। মাত্র ৭ শতাংশ বাজার দখল করে আছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অবকাঠামোগত খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই কোম্পানিগুলো যথেষ্ট বিপদে আছে, এমতাবস্থায় কর আরোপ করলে পুরো খাতটিই নষ্ট হয়ে যাবে।
শুধু তা–ই নয়, সফটওয়্যারের অপারেশন খরচও অনেক বেড়ে যাবে। ব্যাপারটি এমন যে কেউ গাড়ি কিনল, কিন্তু গাড়ি রাখার জন্য প্রতি মাসে বড় অঙ্কের টাকা গ্যারেজ ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই সুখকর কিছু হবে না।
একই কথা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যখন ২০৪১ সাল নাগাদ ৫০টি ইউনিকর্ন স্টার্টআপ ও ৫০ বিলিয়ন ডলার তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে আয়ের কথা বলছি, তখন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের ওপর কর আরোপ করলে আইটি প্রডাক্ট মার্কেটিং খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
বাজেটে আরেকটি হতাশার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো। ভুলে গেলে চলবে না যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে মূল অক্সিজেনই হবে ইন্টারনেট। সরকারকে অনুরোধ করব, বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য।
পরিশেষে বলতে চাই, আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সরকারকে দেখতে হবে বিনিয়োগ হিসেবে। পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেলের কথাই যদি ধরি, সরকার কিন্তু ভালোমতোই জানে যে এই টাকা উঠে আসতে ৩৫ থেকে ৪০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু, তারপরও সরকার এখানে বিনিয়োগ করে। কেন করে জানেন? কারণ, এখানে প্রত্যক্ষ লাভের চেয়ে পরোক্ষ লাভ অনেক বেশি।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতকেও দেখতে হবে একইভাবে। মনে রাখতে হবে যে দেশের সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান করে এই খাত। স্মার্ট বাংলাদেশ হলে মানুষের সময় বাঁচবে, খরচ কমবে আবার দুর্নীতিও অনেকাংশে লাঘব হবে। সরকারকেও চিন্তা করতে হবে সুদূরপ্রসারী ভাবেই।
রাশাদ কবির সাবেক পরিচালক, বেসিস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেড।