পাকিস্তানে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক দিন থেকেই দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে আছে। এখন সেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা ছাপিয়ে রাজনৈতিক সংঘাত মুখ্য হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিরোধী দল তথা পিটিআইয়ের আন্দোলনে ঘি ঢেলে দিয়েছে ইমরান খানের গ্রেপ্তারের ঘটনা।
গত নভেম্বরে এক সমাবেশে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান তাঁকে হত্যার জন্য দুই দফা চেষ্টা চালিয়েছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী কিংবা আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়।
যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা সেনাবাহিনী ও আইএসআইকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে উসকে দেন। পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—সরকার, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনী। কখনো একটি অপরটির মুখোমুখি অবস্থান নেয়, কখনো সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৯ মে তোশাখানা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজিরা দিতে গেলে তাঁকে কমান্ডো কায়দায় গ্রেপ্তার করা হয়, যা ছিল নজিরবিহীন। এরপরই পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকেরা সারা দেশে বিক্ষোভ করেন, সেনা কর্মকর্তার বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালান, আগুন দেন। প্রধান প্রধান শহরে সেনা তলব করেও সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেনি। অনেকে মনে করেন, তারা ইচ্ছা করেই পিটিআই নেতা-কর্মীদের ভাঙচুর করতে দিয়েছে; যাতে ভবিষ্যতে দলের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে।
পাকিস্তানে কে বেশি ক্ষমতাধর? নির্বাচিত সরকার, প্রেসিডেন্ট, সেনাবাহিনী না আইএসআই? সংবিধান মানলে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতাবান হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে যে সেনাবাহিনী ফুলের মালা দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল (পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন), ১৯৭৭ সালে সেই সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং দুই বছর পর এক হত্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
গত বছরের এপ্রিলে ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান জিহাদের ডাক দিলেও সরকারের চণ্ডনীতির সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন তাঁর সদস্যপদ বাতিল করেছে। তাঁকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এবারই তিনি প্রথম আদালত ও সাধারণ মানুষের নৈতিক সমর্থন পেলেন। আদালত অঙ্গনে তাঁর গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পিটিআই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ইমরানের গ্রেপ্তারকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেন। গতকাল শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টও শুনানির পর তাঁর দুই সপ্তাহের জামিন মঞ্জুর করেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছেন সরকারি দলের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, এর মাধ্যমে আদালত দ্বিচারিতা করেছেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর ইমরান খানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে।
ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘ইমরান খানের গ্রেপ্তারের দৃশ্য ভিডিওতে দেখে পাকিস্তানের জনগণ ও আমি ব্যথিত হয়েছি। ভিডিওতে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা এবং একটি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের প্রধান।’ বৃহস্পতিবার তিনি পুলিশপ্রধানের অতিথিশালায় পিটিআইপ্রধানের সঙ্গে দুই ঘণ্টা আলোচনাও করেছেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আরিফ আলভি পিটিআই থেকে দুবার জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।
সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান একসময় সেনাবাহিনীর প্রিয়ভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে পিটিআই ২৭০টি আসনের মধ্যে ৩০টি পেয়ে জাতীয় পরিষদে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পিটিআই ১১৬ আসন পেয়ে অন্যদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মিরের ভাষ্যমতে, ‘সেনাবাহিনীর সাহায্যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান ইমরান।’
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল জাভেদ বাজওয়ার সমর্থনে ইমরান ক্ষমতায় এলেও পরে নানা ইস্যুতে তঁাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অবসরে যাওয়ার পর বাজওয়া এক সমাবেশে বলেছেন, পাকিস্তানের দুর্গতির জন্য রাজনীতিকেরাই দায়ী, সেনাবাহিনী নয়। ভবিষ্যতে পাকিস্তানে সেনাশাসন আসবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। তবে পাকিস্তানি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ক্ষমতায় না থেকেও সেনাবাহিনী পুরোপুরি ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে এবং এক দলকে অপর দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করছে।
পাকিস্তানে কে বেশি ক্ষমতাধর? নির্বাচিত সরকার, প্রেসিডেন্ট, সেনাবাহিনী না আইএসআই? সংবিধান মানলে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতাবান হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে যে সেনাবাহিনী ফুলের মালা দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল (পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন), ১৯৭৭ সালে সেই সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং দুই বছর পর এক হত্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বেনজির ভুট্টো ক্ষমতায় এলেও দুই বছরের মাথায় তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় সেনা নেতৃত্বের বিরোধিতার কারণে। এরপর দৃশ্যপটে আসেন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৯ সালে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় এসে নওয়াজ ও বেনজিরকে নির্বাসনে পাঠান। ২০০৭ সালে বেনজির দেশে ফিরে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন। এরপর পিপিপি ও মুসলিম লিগ পালা করে ক্ষমতায় এলেও কেউ শান্তিতে থাকতে পারেনি।
সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষার্ধে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সুপ্রিম কোর্ট ১৪ মে পাঞ্জাব প্রাদেশিক পার্লামেন্টের নির্বাচন করার নির্দেশ দিলেও সরকার আর্থিক দুরবস্থার দোহাই দিয়ে স্থগিত রেখেছে। ইমরান খান অবিলম্বে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পাকিস্তানের রাজনীতির শেষের শুরু নাকি শুরুর শেষ, সেটি ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com