মতামত

এটুআইকে এজেন্সি করা কতটা যৌক্তিক হলো?

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) বিল, ২০২৩ সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাণিজ্য সংগঠনগুলো
ছবি: প্রথম আলো

‘খাইতে দিলে বসতে চায়,
বসতে দিলে শুইতে চায়,
শুইতে দিলে বাঁশি বাজায়।’
এটি বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এটুআইয়ের সঙ্গে প্রবাদের মূলভাব অনেকটাই মিলে যায়। বারবার নামবদল খেয়াল করলেই তা স্পষ্ট। প্রথমে এটুআইয়ের পূর্ণরূপ ছিল ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’। এরপর ‘এ’-এর অর্থ বদলে গেল। হলো ‘অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট’। অ্যাস্পায়ার মানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ উদ্ভাবন হলো ‘এ-তে এজেন্সি’। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ৫ জুলাই কণ্ঠ ভোটে বিল পাস হয়ে এখন এটুআইয়ের পূর্ণরূপ ‘এজেন্সি টু ইনোভেট’। ১১ জুলাই বাংলাদেশ গেজেটে প্রজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশিত হয়ে এটুআই বিলটি এখন ২০২৩ সালের ২০ নম্বর আইন।

প্রকল্প থেকে সংস্থায় স্থায়ীরূপ পাওয়া এটুআইয়ের সদ্য সাবেক ‘অ্যাস্পায়ার’-এর শেষ কিন্তু এখানেই নয়। এই আইনে আরেকটু উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। চাইলে এই সংস্থা নিজেকে কোম্পানিতেও পরিণত করতে পারবে (ধারা ২১); অর্থাৎ সরকার নিয়ন্ত্রিত নতুন একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারে, যদি এখনকার সংস্থা বা এজেন্সির কর্তাব্যক্তিরা চান। আইনে সেই কোম্পানি গঠনের আবহ সংগীতের সূচনা করা হয়েছে। প্রশ্ন করা যায়, এটুআইয়ের এজেন্সি বা পরবর্তী সময়ে কোম্পানি হওয়ার প্রয়োজন কী?

প্রায় এক বছর আগে এটুআই বিলের খসড়া প্রকাশের পর থেকেই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্য খাতের পাঁচ সংগঠন এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছে। প্রধান কারণ হিসেবে তারা বলছে, এতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বেসরকারি খাত সংকুচিত হয়ে পড়বে। সরকার নিজে সংস্থা করে তথ্যপ্রযুক্তি সেবাসহ নানা রকম কাজ করে, তবে দেশে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে। এটুআই আইনে এই এজেন্সির বিভিন্ন কাজের টেন্ডারে অংশ নেওয়ার সুযোগও আছে। মাসখানেক আগে সংসদে এজেন্সি টু ইনোভেট বিল ২০২৩ উপস্থাপনের পর সংসদীয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সঙ্গেও কথা বলে সংশোধনের আহ্বান জানায় বেসরকারি খাত।

সংসদে এটুআই বিল ২০২৩ পাস হওয়ার পর সেই দাবির সব কটি বিলে যুক্ত না হওয়ায় ১০ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে আইসিটি বাণিজ্য খাতের পাঁচ সংগঠন—বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব  সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো)।

সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য সংগঠনগুলো জানায়, গত ১৮ জুন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় আমন্ত্রিত হয়ে পাঁচ সংগঠনের সভাপতিরা যোগ দেন। এটুআই বিল ২০২৩-এর ১৩টি ধারা ও ১৫টি উপধারায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন তাঁরা। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে তিনটি ওই সভায় গৃহীত হয়—১. এটুআইয়ের নির্বাহী কমিটিতে সব আইসিটি বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধি রাখতে হবে (ধারা-৭)। ২. এটুআই কোনো প্রকার যৌথ বা অংশীদারি কারবারে অংশগ্রহণ করতে পারবে না [ধারা-১২ (ঘ)]। ৩. এটুআই কোম্পানি গঠন করতে পারবে না।

সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার মিলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্য খাত এখন বেশ পরিপক্ব। তারপরও আইসিটি বিভাগের বাণিজ্য করার খায়েশ কেন, তা বোঝা দায়। কিছু মানুষের চাকরি পাকা করা, কাজ পাইয়ে দেওয়া ছাড়া কী লাভ এটুআইকে এজেন্সি, এজেন্সি থেকে কোম্পানি করে তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেখা যায় না। অবশ্য আইসিটি বিভাগ যদি স্করপিয়নকে নিয়ে নিউইয়র্কে কনসার্ট করাতে পারে, সিনেমা প্রযোজনা করতে পারে—তবে এটুআইও বাঁশি বাজাতে পারে বৈকি।

৫ জুলাই সংসদে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক উত্থাপিত এটুআই বিল ২০২৩-এ এই দাবিগুলোর মধ্যে একটি অনুপস্থিত দেখা যায়। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতারা জানান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব; অর্থাৎ এজেন্সি কোম্পানি গঠন করতে পারবে—সেটি এখনো বিদ্যমান, যা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিলোপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই ধারা দেশের আইসিটি শিল্প খাতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতারা। আইন হয়ে যাওয়ার পরও তাই তাঁরা এটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন।

একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। সব কাজে আইসিটির কার্যকর ব্যবহার বাড়াতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে ‘স্ট্রেন্থেনিং দি আইসিটি ক্যাপাসিটি অব প্রাইম মিনিস্টার’স অফিস’ নামের একটি প্রকল্প শুরু হয়। সেই প্রকল্পের শেষ দিকে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে  ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)’ প্রকল্পের যাত্রা শুরু। এর অর্থায়নও করে ইউএনডিপি। যদিও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি সাবেক তত্বাবধায়ক সরকার আসার পর। এই প্রকল্প থেকে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কম্পিউটার, সার্ভার, ই-মেইল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অবকাঠামো ও সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারেই বেশি কাজ হয়। পাশাপাশি দেশে আইসিটির বিস্তার ঘটাতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর এই প্রকল্প আরও বিস্তৃত হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের কথা বলেছিল। ২০০৩ সালে জেনেভায় ও ২০০৫ সালে তিউনিসে জাতিসংঘের তথ্যসমাজ শীর্ষ সম্মেলনের (ডব্লিউএসআইএস) ঘোষণাপত্রে নাগরিকদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তি সর্বজনীন ও একটি অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রের উদ্যোগের অঙ্গীকারও ছিল। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় এটুআইকে। প্রথম দিকে এই প্রকল্পের ফোকাস ছিল ই-গভর্ন্যান্স, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাখায় বিস্তৃত হয়।  প্রকল্পের দপ্তর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

এটুআইয়ের কাজ এককথায় জনগণের দোরগোড়ায় আইসিটির সুফল পৌঁছে দেওয়া। সরকারি নানা রকম দাপ্তরিক কাজ অনলাইনভিত্তিক করা, ব্রডব্যান্ড, আইসিটিসহ বিভিন্ন নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন, সরকারি অফিসের ওয়েবসাইট, সরকারি সেবাগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহি বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা, নির্দেশনা, পরামর্শ ও জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখা এটুআইয়ের কাজ। বাস্তবায়ন করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। ২০২০ সালে এটুআই প্রকল্পে ইউএনডিপির অর্থায়ন শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এটুআইয়ের দপ্তর চলে আসে আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে। নাম বদলে হয় অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। এটি হয়ে যায় আইসিটি বিভাগের একটি প্রকল্প। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এটুআইয়ের চলমান প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির সুফল নিশ্চিতকরণ। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। বর্তমান সরকারের মেয়াদও শেষের দিকে। এই সময়ে এসে এটুআইকে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় পরিণত করা ও কোম্পানি গঠনের সুযোগ রাখা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। এটুআই আইনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে জনবান্ধব সেবাব্যবস্থার উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা প্রদানকল্পে এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) নামে একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’

আইসিটি বিভাগের অধীনে তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে কাজ করার জন্য সাতটি সংস্থা ও কোম্পানি রয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথোরিটি, ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিএ), তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি, বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড (বিডিসিসিএল) ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড। এই সব সংস্থার কাজ কী? এগুলো দিয়ে কি স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়? আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবনী তহবিল প্রকল্পও রয়েছে। সেখান থেকে কয়েক বছর বরাদ্দও দিয়েছে।

এত কিছু থাকার উদ্ভাবনে সহায়তা করার জন্য নতুন করে সংস্থা বা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কোনো প্রয়োজন নেই; বরং এত সংস্থা থাকলে বিভিন্ন কাজ নিয়ে ঠেলাঠেলি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আর কেনই-বা জনগণের করের টাকায় এই সংস্থা গঠন করা হচ্ছে, তার কোনো যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়নি। আইনের শুরুতে শুধু বলা হয়েছে, ‘যেহেতু এটুআই কর্তৃক সৃষ্ট জনকল্যাণমূলক সেবাসমূহকে অধিকতর কার্যকর ও টেকসই করিবার জন্য স্থায়ী কাঠামো সৃষ্টির প্রয়োজন এবং যেহেতু বাংলাদেশ জনবান্ধব সেবাব্যবস্থার উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা প্রদানকল্পে এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) নামে একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’ প্রশ্ন হচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে এটুআই যে কাজ করেছে, সেবা দেওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, সেগুলো কি টেকসই নয়? তবে সরকারের শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প চালানো হলো কেন?

উদ্ভাবন একটি মেধাভিত্তিক বিষয়। সংস্থা করে উদ্ভাবন হয় না। উদ্ভাবনের জন্য গবেষণার সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ, প্রয়োজনীয় সহায়তা করা যেতে পারে। এটুআই নামের এই এজেন্সির যে কার্যাবলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর সবই আইসিটি বিভাগের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ও চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে করা সম্ভব। এটুআইকে এজেন্সি বা কোম্পানি করার প্রয়োজন নেই। বেসরকারি খাতের মুখোমুখি দাঁড় করানোরও প্রয়োজন নেই। বিমান বাংলাদেশ বা টেলিটকের দিকে তাকালে বোঝাও যায়, সব সুবিধা পাওয়ার পরও সরকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ে। কেন কী কারণ—তা কমবেশি সবারই জানা। সরকারের কাজ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহায়তা বা ফ্যাসিলিটেট করা, নিজে ব্যবসা করা নয়।

এটুআই আইনে এই এজেন্সি চালানোর জন্য একটি পরিচালনা পর্ষদ ও একটি নির্বাহী কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। আইসিটি বিভাগের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী এই পর্ষদের সভাপতি থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, অর্থ বিভাগ, আইসিটি বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবেরা এর সদস্য থাকবেন। এফবিসিসিআই ও আইসিটি খাতের পাঁচ সংগঠনের সভাপতি, স্টার্টআপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সরকার মনোনীত একজন করে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও প্রযুক্তিবিদ এর সদস্য থাকবেন। এজেন্সির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করবেন।

অপর দিকে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হবেন আইসিটি সচিব। এখানে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সদস্য হিসেবে থাকবেন এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এই কমিটিরও সদস্যসচিব হিসেবে থাকবেন। প্রকল্প পরিকল্পনা, প্রকল্প গ্রহণ, বিনিয়োগ, ঋণ গ্রহণ, যৌথ কোনো উদ্যোগ বা অংশীদারত্ব চুক্তি ইত্যাদি এই নির্বাহী কমিটি করতে পারবে। আইনটিতে নির্বাহী কমিটির ক্ষমতা স্পষ্টতই বেশি রাখা হয়েছে। এককথায় এই এজেন্সির সর্বেসর্বা হতে যাচ্ছেন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। বোঝা যাচ্ছে, পরিচালনা পর্ষদের কাজ হবে অনেকটা রাবার স্ট্যাম্পের মতো।

আইনটির ২২ নম্বর ধারা ক্ষমতা অর্পণ বিষয়ে। এতে বলা হয়েছে, ‘পরিচালনা পর্ষদ প্রয়োজনে ইহার কোনো ক্ষমতা, লিখিত আদেশ দ্বারা ও নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কোনো সদস্য, কর্মচারী বা কোনো কমিটিকে অর্পণ করিতে পারিবে।’ মানে, এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত যে কেউই এই সংস্থা পরিচালনার ক্ষমতা পেতে পারেন।

এটুআই আইনের ২১ ধারাটি হলো কোম্পানি গঠনের ক্ষমতা। এটি নিয়ে আপত্তি বেশি। সংসদে জাতীয় পার্টির একাধিক সংসদ সদস্যও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন এই কোম্পানি গঠনের ধারা ধরে। ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এজেন্সি, প্রয়োজন অনুযায়ী কোম্পানি গঠন করিতে পারিবে।’ যদিও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী সংসদে ও বাইরে বারবার বলে আসছেন, কোম্পানি করে ব্যবসা করা হবে না, কিন্তু আইনে তো বাধা নেই।

কথা হচ্ছে, এটুআই প্রকল্প হিসেবে অনেক কিছু করেছে ও করে। ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য এটুআই জার্নি: মেকিং ডিজিটাল ইনোভেশন ওয়ার্ক ফর দ্য পুওর’ নামের ঝকঝকে এক প্রকাশনায় সেসবের তথ্যও রয়েছে। এই বইতে এটুআইকে ডিজিটাল বাংলাদেশের পতাকাবাহী (ফ্ল্যাগশিপ) কর্মসূচি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার জন্ম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং ১১ বছর ধরে এটি কাজ করে যাচ্ছে, বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এটুআইয়ের জন্ম ২০০৬ সালে। কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী করেছে, সংখ্যার হিসাবে সেগুলো লেখা রয়েছে। হাজার হাজার ওয়েবসাইট, ই-সেবা, ই-কমার্স; উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এর কত শতাংশ সত্যিকার অর্থে কার্যকর ও টেকসই হয়েছে। কোথাও কোনোটা কাজ না করলে তাদের উত্তর এটি তো অমুক অফিস রক্ষণাবেক্ষণ করে তারা বলতে পারবে। এটুআই এত কিছু করার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা কীভাবে হ্যাকারদের হাতে চলে যায়, কীভাবে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যায়—এসব প্রশ্ন উঠতেই পারে।

সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার মিলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্য খাত এখন বেশ পরিপক্ব। তারপরও আইসিটি বিভাগের বাণিজ্য করার খায়েশ কেন, তা বোঝা দায়। কিছু মানুষের চাকরি পাকা করা, কাজ পাইয়ে দেওয়া ছাড়া কী লাভ এটুআইকে এজেন্সি, এজেন্সি থেকে কোম্পানি করে তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেখা যায় না। অবশ্য আইসিটি বিভাগ যদি স্করপিয়নকে নিয়ে নিউইয়র্কে কনসার্ট করাতে পারে, সিনেমা প্রযোজনা করতে পারে—তবে এটুআইও বাঁশি বাজাতে পারে বৈকি।  

পল্লব মোহাইমেন প্রথম আলোর হেড অব নিউ ইনিশিয়েটিভ