তুরস্কে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দুই দশকের দমন-পীড়নের শাসন ও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে দেশটির ছয়টি বিরোধী দল নিজেদের মতভিন্নতা সরিয়ে রেখে অবশেষে আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থী দাঁড় করানোর বিষয়ে একমত হয়েছে।
এ মাসেই ছয়টি পক্ষ একজোট হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কেমাল কিলিসদারোগলুকে তাদের প্রার্থী হিসেবে ঠিক করেছে।
যখন একটি জনতুষ্টিবাদভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্র নিয়ে কারসাজি করছে, তখন সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, বিরোধী দলগুলো সে অবস্থা থেকে মুক্ত হতে একজোট হবে। কিন্তু সেই ঐকমত্যে পৌঁছানোই শেষ কথা নয়; বস্তুত কঠিন ধাপটি আসে একতাবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর।
বিরোধী দলগুলোকে এরদোয়ানের মতো ‘একজন জনতুষ্টিবাদী লৌহমানব’কে উৎখাত করতে হলে তাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ঊর্ধ্বে উঠে আরও কিছু করতে হবে। সবার মনে রাখতে হবে, জনতুষ্টিবাদী নেতাদের গণতন্ত্রকে খাটো করার প্রমাণিত রেকর্ড থাকে এবং যৌক্তিকভাবেই বিশ্বাস করা হয়, তাঁরা পুনরায় ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্রের আরও ক্ষতি করবেন।
যেমন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান অস্বচ্ছ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাঁর কর্তৃত্ববাদী আচরণকে আরও তীব্র করেছেন।
জনতুষ্টিবাদীরা ক্ষমতায় গেলে সমস্ত রাজনীতি শক্তিশালী ব্যক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আর জনতুষ্টিবাদী নেতারা ঠিক সেটিই চান। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব সুবিধার জন্য মেরুকরণ এবং ব্যক্তিগতকরণ ব্যবহার করতে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, সবাই তাঁর বিরুদ্ধে এবং একমাত্র তিনি সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নেতা।
তুরস্কের ক্ষেত্রে এটি আরও সত্য। সেখানে বিরোধী ছয়টি দল কেমাল কিলিসদারোগলুকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করলেও ছয়টি দলের কাছে তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন নেই। আর কেমাল নির্বাচিত হলে তাঁরা কী কী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করবেন, সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা ভোটাররা পাচ্ছেন না। ফলে এই নেতৃত্বের পক্ষে এরদোয়ানের মতো জনতুষ্টিবাদীকে হারানো তথা গণতন্ত্রকে অধিকতর হুমকি থেকে বাঁচানো কঠিন হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ভোটারদের সবাই যে জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব এবং গণতন্ত্রকে হুমকির মধ্যে ফেলার বিষয়টি জানেন না, বিষয়টি মোটেও তা নয়। কিন্তু যখন তাঁরা ‘আমরা বনাম তারা’ যুক্তি ধরে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং দেখে, বিরোধী জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনিশ্চিত, তখন তাঁরা মন্দের ভালো হিসেবে জনতুষ্টিবাদের ভেতরেই আশাবাদ খোঁজার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করে যাঁকে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়, তাঁর প্রতি শরিক দলগুলোর এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যেন তিনি তাঁদেরই বিরোধী পক্ষ। গত বছর হাঙ্গেরির চরম ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে দেশটির সব বিরোধী দল একজোট হয়ে একজন ক্যাথলিক প্রাদেশিক মেয়রকে দাঁড় করিয়ে দেন। একইভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পরাস্ত করতে বিরোধীরা একজোট হয়ে বেনি গান্টস নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে দাঁড় করান। উভয় ক্ষেত্রেই বিরোধীরা ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, নিজেদের মনোনীত প্রার্থীর নেতৃত্ব নিয়ে তাঁদের নিজেদের ভেতরই সংশয় ছিল।
তুরস্কের ক্ষেত্রে এটি আরও সত্য। সেখানে বিরোধী ছয়টি দল কেমাল কিলিসদারোগলুকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করলেও ছয়টি দলের কাছে তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন নেই। আর কেমাল নির্বাচিত হলে তাঁরা কী কী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করবেন, সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা ভোটাররা পাচ্ছেন না। ফলে এই নেতৃত্বের পক্ষে এরদোয়ানের মতো জনতুষ্টিবাদীকে হারানো তথা গণতন্ত্রকে অধিকতর হুমকি থেকে বাঁচানো কঠিন হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক