যখন বেসরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, তখন সবার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের জন্য পেনশন স্কিম করার অনুরোধ এসেছিল। সরকারও এ ব্যাপারে কাজ করছিল। প্রশংসাজনক দ্রুততায় সরকার নিজেদের ইশতেহারে দেওয়া কথা পূরণ করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই স্কিম জীবনবিমা আর ডিপিএসের মতো করে করা হয়েছে। যখন আইনটি পাস হয়, তখন জাতীয় পার্টির সদস্যরা বিরোধিতা করলেও তা আমলে না নিয়ে, মানুষের জন্য লাভজনক না করেই এই আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে, সমস্যা থাকলে তা সংশোধন করা হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন, সরকারি আইন সংশোধন কতটা কষ্টের।
আমার লেখাকে ফিন্যান্সিয়াল আর নন-ফিন্যান্সিয়াল—এই দুই ভাগে ভাগ করব। প্রথমেই আসি ফিন্যান্সিয়াল অংশ নিয়ে।
বোঝার সুবিধার জন্য আমি প্রগতি স্কিমের মাসের ৫ হাজার টাকা করে ২০ বছর ধরে দেওয়া স্কিম নিয়ে হিসাব করি। পেনশন স্কিমে সুদ ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ জুন, ২০২৩)। এই হারে যদি ২০ বছর টাকা রাখা হয়, আমি পাব ২৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩০০ টাকা (ডিপিএস ক্যালকুলেটর)।
এরপর থেকে সরকার দেবে ২৪ হাজার ৬৩৪ টাকা করে ন্যূনতম ১৫ বছর। সেই হিসাবে মোট হয় ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ১২০ টাকা। এখন সিস্টেমেটিক উইথড্রয়াল প্ল্যান ক্যালকুলেশনে যাই। যেখানে আমার শুরুর বিনিয়োগ ২৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩০০ টাকা। মাসিক উত্তোলন ২৪ হাজার ৬৩৪ টাকা এবং এই ক্ষেত্রে আমার জমার ওপর সুদ ৮ শতাংশ বাৎসরিক কিন্তু রয়ে যাবে। সেই হিসাবে ১৫ বছর শেষে ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ১২০ টাকা দেওয়ার পরও সরকারের হাতে থাকবে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৮ টাকা।
দেশের গড় আয়ু এখন ৭২.৪ বছর। সে কারণে ৭৫ বছর পর খুব বেশি মানুষকে টাকা দেওয়া লাগবে না। কিন্তু আমার নিজের প্রাপ্য টাকা ব্যাংক সুদসহ পেতে সময় লাগবে ১৮ বছর; মানে ৭৮ বছর। তার মানে, গড়ে সব স্কিম থেকে বেশ বড় একটা টাকা সরকারের হাতে থেকে যাবে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক।
মূল্যস্ফীতির হিসাবে বিনিয়োগকারীর ক্ষতি: আজ থেকে ২০ বছর পর আমি প্রতি মাসে পাব মাসে ২৪ হাজার ৬৩৪ টাকা, যা মূল্যস্ফীতি যদি ৯ শতাংশ (এখনকার মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবে ৯.৬৩ শতাংশ) হয় তাহলে এই টাকার মূল্যমান বর্তমান সময় হিসেবে হবে মাত্র ৪ হাজার ৩৯৭ টাকা (বর্তমান মূল্য ভবিষ্যতের টাকার হিসাব)। আমি যদি ৭৫তম বছরে যাই, এই মূল্যমান যা হবে তা নিয়ে কথা বলা অবান্তর। মূল্যস্ফীতি হিসেবে বিনিয়োগকারীরা তাঁর আসল টাকাই ফেরত পাবেন না।
অতি নিম্ন সুদহার: আমরা ফিন্যান্স যাঁরা পড়েছি, তাঁরা জানি বিনিয়োগে যত লম্বা সময়, তত রিস্ক। এখনকার অনেক ব্যাংক ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। সেখানে ৮ শতাংশ সুদহার বেশ কম। এই সুদহার দিয়ে কারও জন্য পেনশনে বিনিয়োগ লাভজনক হওয়া সম্ভব না। এখানে অপরচুনিটি কস্ট হিসেবে যদি সোনার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে হতাশা আরও বাড়বে।
ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা: যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ায় পেনশন খাতে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ১০ লাখ ডলার হারান। সোনালী ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে ঋণখেলাপির হার কমালেও তাদের ঋণ দেওয়ার হার অনেক বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। ঋণখেলাপি না বাড়ার বড় কারণ, সরকারি কিছু সুযোগ দেওয়া। দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের মনে বেশ সন্দেহ আছে। এমনকি সোনালী ব্যাংকেও স্ক্যামের ঘটনা আছে। এই সন্দেহ দূর করা দরকার এবং তার জন্য ব্যাংকিং খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে।
সরকারি খাতে দুর্বলতা: ২০৩০ সালের পর থেকে সরকারকে ৫.১৫ বিলিয়ন ডলার করে ঋণ শোধ করতে হবে। ১০ বছর পর যখন বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন তখন সরকার কি টাকা দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকবে? পেনশন স্কিমের টাকা দিতে না পারার ঘটনা দেখা যায় গ্রিস, স্পেনসহ ইউরোপের দেশেও। তাদের আবার নতুন করে পেনশন স্কিম পুনর্গঠন করা লেগেছিল।
দ্বৈত আইন: পেনশন স্কিম সর্বজনীন হলেও এখানে সরকারি কর্মচারীদের রাখা হয়নি। তাঁদের বেসরকারি খাতের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পেনশন দেওয়া হবে, যা দ্বৈত আইন। সবার অংশগ্রহণ না থাকায় এই পেনশন স্কিম আসলে কন্ট্রিবিউটেড হয়েছে সর্বজনীন না হয়ে। এ জন্য সরকারি পেনশন খাতে সরকারকে এই বছরও বাজেটের ৭.৪ শতাংশ টাকা দিতে হচ্ছে। এটা ঠিক, যারা সুযোগ পাচ্ছে, তাদের জন্য সুযোগের পরিবর্তন করা কঠিন।
সরকারের উচিত ছিল, যাঁরা ২০২৪ থেকে সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের এই স্কিমে যুক্ত করা। এতে মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করত, খরচও কমত। আর এই স্কিম পুরোপুরি তৈরি করেছেন সরকারি আমলারা। এটা যদি লাভজনকই হতো, তাহলে তাঁরা নিজেদের এর সঙ্গে যুক্ত রাখতেনই।
পেনশন পেতে হেনস্তা: যদিও দাবি করা হচ্ছে, পেনশন পেতে এখন আগের থেকে কম সময় লাগে। কিন্তু শিক্ষা বার্তার ১৮ এপ্রিল ২০২৩-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক পেনশন পেতে সমস্যায় ভুগছেন। তাই মানুষের মনে সন্দেহ থেকে যাবেই।
ধর্মীয় চিন্তা: আমাদের দেশের অনেক মানুষ সুদ আছে দেখে এই স্কিম নিতে আগ্রহী হবেন না।
ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যাফেয়ার-এর একটা চমৎকার বই আছে—পেনশন প্রভিশন: গভর্নমেন্ট ফেইলিউর অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড। সেখানে লেখকেরা দেখিয়েছেন, উন্নত বিশ্বে যেখানে ট্যাক্স থেকে সরকার মানুষদের পেনশন দেয়, তারা বেশ সফল। কন্ট্রিবিউটেড পেনশন (আমাদেরটি কন্ট্রিবিউটেড, সর্বজনীন হয়নি) প্রায় সব দেশেই শুরুতে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক দেশকে শুরু করেও ব্যর্থতার জন্য আবার নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে। আর নিম্ন আয়ের দেশে এখন পর্যন্ত আর্থিক দুর্বলতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি—এসব কারণে পেনশন স্কিম সফলতার মুখ দেখেনি।
আমাদের দেশের পেনশনে সরকার কোনো ট্যাক্সের আয় শেয়ার করছে না, সামাজিক নিরাপত্তা থেকে কোনো খরচও করছে না (সুরক্ষা খাতে থাকলেও তা আইনমতে পুরোই সরকারের মর্জি), এমনকি এই টাকা বিনিয়োগ করে সরকারের যে মুনাফা হবে, তারও শেয়ার নেই (এটি বিরল উদাহরণ)। এই স্কিম তাই মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়া খুব কঠিন। কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টর এখানে অনেক বেশি। আর ফিন্যান্সিয়ালি লাভজনক না। যখন কোনো স্কিমে রিস্ক বেশি থাকে, তার লাভও সেই হিসেবে বেশি হতে হবে—এটাই ফিন্যান্সের মূল পাঠ।
বিশ্বের অনেক দেশেই পেনশন স্কিম শুরুর পর আবার পুনর্গঠন করা লেগেছে। এটিই স্বাভাবিক। ভুল থেকেই সবাই শিক্ষা নেয়। সরকারের যদি সদিচ্ছা থেকেই থাকে, তাহলে শুরুতে খুঁতগুলো বন্ধ করতে সরকারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বেসরকারি বিশেষজ্ঞ (যেহেতু প্রায় পুরো খাতের টাকাই বেসরকারি খাত থেকে আসবে) এবং একাডেমিশিয়ানদের প্যানেল করে আইন আরও নিখুঁত, ফিন্যান্সিয়াল মানুষের জন্য আরও লাভজনক, কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং সরকারি মানুষজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত। তাহলেই মানুষের মধ্যে আসবে আস্থা। লাভ থাকলে প্রচারণা ছাড়াই মানুষ এতে যুক্ত হবে। আমরা হতে পারব অন্য কোনো দেশের গবেষণার বিষয়।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই-মেইল: subail001@gmail.com