টাকার বিনিময়ে মই দিয়ে পথচারীদের সড়ক বিভাজক পার করা হচ্ছে।
টাকার বিনিময়ে মই দিয়ে পথচারীদের সড়ক বিভাজক পার করা হচ্ছে।

মতামত

মই দিয়ে রবিউল কেন শর্টকাটে ‘ধনী’ হতে চাইবে না?

ভাইরালের এই দুনিয়ায় কপাল পুড়েছে রবিউলের। তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মই পেতে ৫ টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের সড়ক বিভাজক পার করছিলেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মই হাতে রবিউলকে মাঝখানে রেখে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে পুলিশ ছবি তুলে সংবাদপত্রগুলোকে সরবরাহ করেছে। এই তৎপরতার জন্য পুলিশকে ধন্যবাদ। এভাবে মহাসড়ক পার হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

যদিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর পড়ে মনে হচ্ছে ‘ডাল মে অর কুছ কালা’ আছে। যেমন দূরপাল্লার বাসগুলো আঞ্চলিক সড়কের বদলে যাত্রী নামাচ্ছে মহাসড়কের মাঝখানে। আর চার ফুট উচ্চতার সড়ক বিভাজকের অপর পাশে আঞ্চলিক সড়ক। আগে আঞ্চলিক সড়কে ওঠার জন্য সড়ক ও জনপদ (সওজ) একটা দরজা রেখেছিল। যাত্রীরা দরজা পেরিয়ে আঞ্চলিক সড়কে গিয়ে উঠত। সেই দরজা কয়েক মাস ধরে বন্ধ।

তবে  রবিউল গ্রেপ্তারের পর ‘ডাল মে’ আরও যত ‘কালা’ আছে, তার সবই মনের মধ্যে উজিয়ে উঠল। ‘সেতু আছে রাস্তা নেই’ লিখে গুগলে একটা সার্চ দিলে আপনার দশাও হবে আমার মতো। এর মধ্যে সর্বসাম্প্রতিক খবরটি ছেপেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। কাঠ ও বাঁশের মই দিয়ে মুন্সিগঞ্জের চর কেওয়ার ইউনিয়নে সেতু পার হতে হচ্ছে। ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতুর নির্মাণকাজ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) শেষ করার কথা। শেষ হয়নি।

কৃষিপ্রধান এই ইউনিয়নের বাসিন্দারা কৃষিপণ্য নিতে সমস্যায় পড়েছেন। বয়স্ক মানুষ, সন্তানসম্ভবা নারী, শিশুদের অবস্থা আরও করুণ। এলজিইডি নাকি চার মাস ধরে সেতুর ঠিকাদারকেই খুঁজে পাচ্ছে না। আচ্ছা, এলজিইডি কেন পুলিশের সাহায্য নেয় না? ক্লু লেস কতশত খুনি-ডাকাত তারা ধরে ফেলল, আর ঠিকাদারকে খুঁজে বের করা তো কোনো বিষয়ই না। অবশ্য এ দেশে টাকা যার যত বেশি, আইনের সুরক্ষাও তার বেশি।  

এই সমাজের একশ্রেণির মানুষের অবশ্য বিকল্প উপদেশ-পরামর্শ কিছুই লাগে না। ফেসবুকে এক ফুড ব্লগারের ভিডিও ঘুরছে। তিনি ৫৩ হাজার টাকার ইফতার অর্ডার করেছেন। যে রেস্তোরাঁ থেকে তিনি খাবার অর্ডার করেছেন সেখানে পাঁচটির নিচে অর্ডার নেওয়া হয় না। এসব রেস্তোরাঁ কি চলছে না? রেস্তোরাঁর সব ক্রেতাও ব্যাংকখেকো, সিন্ডিকেটবাজ, লুটেরা হয়তো নন। কিন্তু বৈষম্যটা তো আকাশ ছুঁয়েছে।

সে যাক। রবিউলের হঠাৎ শর্টকাটে ধনী হওয়ার খায়েশ হলো কেন? প্রশ্নটা বোধ হয় আরেকটু ঘুরিয়েও করা যায়। রবিউলের শর্টকাটে ধনী হওয়ার খায়েশ হবে না কেন? গোটা দেশই তো শর্টকাটে চলছে। ব্যাংক ফাঁকা করে দিয়ে শর্টকাটে হরদম লোকে ধনী হচ্ছে। ই-কমার্সের নামে ই-ভ্যালির রাসেল ও তাঁর স্ত্রী শামীমাসহ কত লোকের আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। পাওয়ার কাপল হিসেবে তাঁদের নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হলো, তাঁরা এখানে–ওখানে টাকা দিয়ে বেড়ালেন, তাঁদের টাকায় সরকারি সংস্থা সিনেমা বানাল।

সব পণ্যের মৌসুমি সিন্ডিকেট আছে। তাদেরও বেশুমার টাকা। ডিম-মুরগি- গরুর স্থায়ী সিন্ডিকেট। রোজার দিনে খেজুরের, বেগুনের অস্থায়ী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট পার্টি খুবই শক্তিশালী। তাঁরা ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজির এলাচি ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করলেও তাঁদের কেশাগ্র ছোঁয়ার ক্ষমতা কারও নেই। কারণ, তাঁরাই দেশের হর্তা–কর্তা।

চলুন দেখি, রবিউলদের জন্য রাষ্ট্র কী করে, আর ব্যাংকখোর, সিন্ডিকেটবাজ, লুটেরাদের জন্য রাষ্ট্র কী করে। রবিউলদের জন্য রোজার মাসে বেগুনির বদলে ‘পেঁপেনি’, খেজুরের বদলে বরই, বড়জোর ‘নিম্নমানের’ খেজুর খাওয়ার পরামর্শ। এ দেশে আপনি গরিব মানে আপনার কোনো মর্যাদা নেই। আপনার জন্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খেজুরের দাম বেঁধে দেওয়াসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘অতি সাধারণ বা নিম্ন মানের খেজুরের প্রতি কেজির দাম ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা’। পরে অবশ্য দুঃখও প্রকাশ করেছে। কিন্তু এত প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের দেশের নাগরিকদের জন্য কেন  ‘নিম্নমানের’ খেজুর আমদানি করতে হয়।

আপনাকে রাষ্ট্র কী চোখে দেখে তো বুঝলেনই। তাহলে আপনি কেন পুষ্টিকর খাবার চান? আপনার কেন খেজুরের ক্যালরি, ফ্যাট, সোডিয়াম, প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফোলেট, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, সুগার, পটাশিয়াম ও আয়রন লাগবে? বরইয়ে তো ভিটামিন সি, এ, বি আরও তিন ধরনের খনিজ আছে। ওই খেয়ে থাকবেন। দুটো একসঙ্গে খাওয়ার চিন্তা ভুলেও করবেন না। করলেও কিনতে পারবেন না। কারণ, যাদের জন্য দুবেলা পেটপুরে খাবার জোটানো কঠিন তারা ১০০ টাকা কেজি বরই ও ৩০০ টাকা কেজি দিয়ে নিম্নমানের খেজুর কোনোটাই কিনে খাবেন না।

সেই জনগোষ্ঠীর কথাই আজ (১৮ মার্চ) দ্য ডেইলি স্টার বলেছে। তাদের খবর হলো, ২০২৩ সালে ৩ দশমিক ৭৭ কোটি মানুষ মাঝারি থেকে মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২৯ হাজার ৭৬০টি গৃহস্থালিতে জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে। তারা জানাচ্ছে, জরিপের আওতায় আসা মানুষের অন্তত দেড় শতাংশ সারা দিন ক্ষুধার্ত থেকেছে এই নজির আছে। ৩ শতাংশ মানুষ বলেছে, মাসে এক-দুবার তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।

কাজেই কৃচ্ছ্র সাধন করুন। শীর্ষ পর্যায় থেকে তা-ই বলা হয়েছে। বড় করে ইফতার পার্টি করবেন না। দেখলেন না দেশপ্রেমিক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যে ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যাবেলা বন্ধু-সতীর্থদের নিয়ে মুড়ি মেখে ইফতার করত, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। তাদের নকল করল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আমজনতা কী করতে পারে তার একটা ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ঘুরছে, এক ব্যক্তি রিকশায় মাইক লাগিয়ে বাজারে ঘুরছেন আর বয়কট, বয়কট বলে চিৎকার করছেন। তিনি অবিশ্রান্ত বলেই যাচ্ছেন, ‘২০ টাকার বেশি আলু। বয়কট! বয়কট! ৪০ টাকার বেশি পেঁয়াজ, বয়কট বয়কট! তোমরা যা খুশি করছ। ফাজলামি করছ, শয়তানি করছ, লাই পেয়ে গেছ।’ তাতে অবশ্য কারও কিছু যায়–আসে না। কেউ ওই ভিডিওদাতাকে দেখলে বরং সাবধান করবেন। তাঁর গায়ে ‘দেশবিরোধী’ বা অন্য কোনো তকমা লাগতে পারে।

এই সমাজের একশ্রেণির মানুষের অবশ্য বিকল্প উপদেশ-পরামর্শ কিছুই লাগে না। ফেসবুকে এক ফুড ব্লগারের ভিডিও ঘুরছে। তিনি ৫৩ হাজার টাকার ইফতার অর্ডার করেছেন। যে রেস্তোরাঁ থেকে তিনি খাবার অর্ডার করেছেন সেখানে পাঁচটির নিচে অর্ডার নেওয়া হয় না। এসব রেস্তোরাঁ কি চলছে না? রেস্তোরাঁর সব ক্রেতাও ব্যাংকখেকো, সিন্ডিকেটবাজ, লুটেরা হয়তো নন। কিন্তু বৈষম্যটা তো আকাশ ছুঁয়েছে।

এখন বলুন, রবিউল বা আপনি-আমি কেন শর্টকাটে ধনী হতে চাইব না?  

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল ঠিকানা sabiha.alam@prothomalo.com