বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা পানি মাড়িয়ে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুর এলাকা, বুড়িচং, কুমিল্লা, ২৪ আগস্ট
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা পানি মাড়িয়ে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুর এলাকা, বুড়িচং, কুমিল্লা, ২৪ আগস্ট

ত্রাণ দিতে গিয়ে যে প্রশ্ন মাথায় রাখা জরুরি

ছাত্র-জনতার একটি সফল আন্দোলন শেষ হতে না হতেই দেশ বন্যার এক অসম্ভব বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখনো স্থির হয়ে বসতে পারেনি। নানা রদবদলে প্রশাসন এখনো টলমলে। স্থানীয় সরকারের নানা জায়গায় শূন্যতা। ফলে বন্যার্তরা এবার এক মারাত্মক অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ত্রাণব্যবস্থা বিপর্যস্ত।

এর মধ্যেও একটা ইতিবাচক ছবি দেখতে পাচ্ছি। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে বিপুল সংখ্যায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে যেভাবে মানুষ ত্রাণসহায়তা দিচ্ছেন, তা অভাবনীয়। এই নাগরিক সক্রিয়তার মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে।

আবার এই ইতিবাচক ছবির মধ্যেও একটা শঙ্কার চিহ্ন লক্ষ না করে পারছি না, যা এই লেখার বিষয়বস্তু। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে এমন ধরনের কিছু খাবার দেখতে পাচ্ছি, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্যাদুর্গতের সাহায্য না করে উল্টো তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ত্রাণ হিসেবে দেওয়া কিছু খাবার শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, ত্রাণ হিসেবে গুঁড়া দুধ, বাণিজ্যিকভাবে তৈরি রাসায়নিকমিশ্রিত জুস ও সিরিয়াল বিতরণ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষেরা অত গভীরভাবে না ভেবে সরল বিশ্বাসে শিশুদের জন্য মমতা বোধ করেই নিশ্চয় এসব খাবার দিচ্ছেন। শিশুখাদ্যের চাহিদার কথা স্বাভাবিকভাবেই সবার মাথায় আছে। আর শিশুখাদ্যের কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই অনেকে দুধের কথা ভাবছেন এবং অতি দ্রুত গুঁড়া দুধের দিকে মন চলে যাচ্ছে।

অনেকেই জানেন না যে ত্রাণসামগ্রী হিসেবে গুঁড়া দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন কিছু আইনি বিধিনিষেধ আছে, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের ক্ষেত্রেই যা প্রযোজ্য। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে শিশুর খাবার হিসেবে বিতরণের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও মেনে চলার রীতি আছে। গুঁড়া দুধ, কেমিক্যালমিশ্রিত জুস, সিরিয়াল ইত্যাদি সেই মানদণ্ডের পরিপন্থী শিশুখাদ্য।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২-এর দ্বিতীয় ধারার ১১ অনুচ্ছেদে দুর্যোগে বিপর্যস্ত নানা রকমের ব্যক্তির সঙ্গে পাঁচ বছরের নিচে যেকোনো শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প, বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শিশুর বাড়তি খাবার ইত্যাদি বিতরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’-এ বিষয়টিকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

এসব আইন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাঠকর্মীদের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ২০২০ সালে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। তার ভিত্তিতে বলতে হয়, গুঁড়া দুধ মায়ের দুধের বিকল্প ছাড়া আর কিছু নয়। জুস, দোকান থেকে কেনা সিরিয়াল বা দুধের বোতলও বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা শিশুর বাড়তি খাদ্য ও ব্যবহারের সরঞ্জামাদির তালিকাতেই পড়ে।

তবে ওপরে উল্লেখিত নিষেধাজ্ঞাটি নিছক আইনি নয়, এর একটি বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এসবের স্বাস্থ্যঝুঁকি মাত্রাতিরিক্ত। পুষ্টিবিদেরা তাই শিশুখাদ্যের ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হতে বলেন।

সাধারণ অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক বা যেকোনো দুর্যোগে প্রথমেই দেখা দেয় নিরাপদ খাবার পানির আকাল। খাদ্যাভাবে মরিয়া লোকজন অনেক ক্ষেত্রেই দূষিত পানি দিয়ে দুধ গুলিয়েই ক্ষুধার্ত শিশুকে খাইয়ে দেন। বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় শিশুর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এতে অনেক বেড়ে যায়।

রাসায়নিকমিশ্রিত জুস বা সিরিয়াল ধরনের খাবারকে বলা হয়ে থাকে ‘এম্পটি-ক্যালরি’ বা ক্যালরিশূন্য খাবার। অর্থাৎ এসব খাবারে কোনো পুষ্টিগুণ থাকে না। এ ধরনের অতিমিষ্টি খাবার থেকে শিশুরা সামান্য কিছু শক্তি ছাড়া প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদির মতো কোনো উপাদান পায় না। এসব খাবার কোনো পুষ্টি না জুগিয়ে পেটটি নিছক ভরিয়ে তোলে। অথচ এসবের বদলে খিচুড়ি ও সুজি কিংবা চিড়া, বাদাম, খেজুর খাওয়ালে শিশু দরকারি পুষ্টি পেতে পারে।

দুর্যোগের দিনগুলোয় যেখানে তিন বেলা খাবার জোটে না, তখন এমন খাবার নির্বাচন করা উচিত, যা অল্প পরিমাণে খেলেও ন্যূনতম পুষ্টিটুকু নিশ্চিত করে; শিশুর স্বাস্থ্যের ভাঙন ঠেকায়।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিকায় কিছু খাবারের নাম দেওয়া আছে, এ রকম সময়ে যা দারুণ উপকারে আসতে পারে—চাল, ডাল, সুজি, তেল, চিনি বা গুড়, বাদাম, খেজুর ইত্যাদি। রান্নার সুবিধা থাকলে কিছু কিছু খাবার রান্না করে শিশুকে খাওয়ানো যায়। বাদাম বা খেজুর তো এমনিই খাওয়ানো সম্ভব। এসব খাবার দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে শিশুর স্বাস্থ্য অটুট রাখবে।

বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় খিচুড়ি সরবরাহের চল আছে। খিচুড়ি আদর্শ খাবার। শিশুর পুষ্টির জন্যও ভালো। নবজাতক থেকে পাঁচ-ছয় মাস বয়সী যেসব শিশু সুজি বা খিচুড়ি খেতে পারে না, তাদের জন্য মায়ের দুধই যথেষ্ট। সে শিশুর এমনকি পানির প্রয়োজনও নেই। শুধু নিশ্চিত করতে হবে, শিশু যেন মায়ের সান্নিধ্যে থাকে, আর মা যেন পর্যাপ্ত খাবার পান। যে মা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন, তাঁর দুধ পেলে শিশুর আর কিছুরই দরকার হয় না।

ত্রাণের মতো হিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত লোকেরা এই বিষয়গুলো মেনে চললে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবন রক্ষার উপকরণ কারও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হবে না, বরং তাঁদের শ্রম ও শুভ চেতনার ফল ভালোভাবে পাবেন।

  • আসফিয়া আজিম জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ