১৩ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত ঠগিরা বাংলা এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বলা হয়ে থাকে ১৭৪০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তখন ১৮৩০ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানকে ঠগিদের নির্মূল করার আদেশ দেন। স্লিম্যানের কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন।
মানুষ হত্যা ছিল ঠগিদের নেশা ও পেশা। তারা এটা করত বংশপরম্পরায়। সাধারণত ১৮ বছর বয়স হলেই একজন ঠগির সন্তান মানুষ হত্যার অনুমতি পেত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বেশকিছু হত্যাকাণ্ড দেখে মনে হয়, দেশে যেন আবার ঠগি সংস্কৃতি ফিরে এসেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে গান গাইতে গাইতে শাহাদাত নামের এক যুবককে হাত–পা বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করেছে একদল ছেলে। গত ১৩ আগস্ট নগরীর ২ নম্বর গেট গোলচত্বরে একটি ট্রাফিক ছাউনির স্টিলের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে গানের সুরে নেচে নেচে সাতজন যুবক তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। খুনিদেরই একজন পুরো ঘটনাকে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
শুরুতে এই ভিডিও কেউ বিশ্বাস করতে চাননি। ভেবেছিলেন, আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক মিথ্যা ঘটনাও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটিও হয়তো এমনই কিছু একটা হবে। পরে যখন জানা যায় ঘটনাটি সত্য, তখন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে মাঠে নামে পুলিশ। তবে এখনো তাদের ধরতে পারেনি। যতটুকু জানা যায়, হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্তত একজন ছিল শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাওনা টাকা নিয়ে তার সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই তাঁকে ঘটনার দিন বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে।
এদিকে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মানসিক প্রতিবন্ধীকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র। হত্যা করার আগে তাঁকে ভাত খাইতে দিয়েছিল খুনিরা। তাঁকে নির্যাতনের বিভিন্ন দৃশ্য ভিডিও করা হয়। পরে তা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর খুনের ঘটনাটিও ভিডিও করে কেউ।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কিছু মানুষ এই অবস্থাটার সুযোগ নিচ্ছে। ফলে দেশজুড়ে গড়ে উঠছে এক নির্মম ‘ঠগি সংস্কৃতি’। কোথাও কোথাও মানুষ মেতে উঠছে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো খুনের আনন্দে, খুন দেখার আনন্দে। এর ফল যে সুখকর হওয়ার নয়, তা তো বলাই বাহুল্য।
এ সব কটি খুনের ঘটনায় একটি বিষয় কমন—তা হলো খুনিদেরই কেউ না কেউ খুনের দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেছে এবং পরে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। সব কটি ঘটনাতেই খুনিদের খুব উল্লসিত এবং উৎফুল্ল মনে হয়েছে। যেন এই খুনের মাধ্যমে তারা বড় ধরনের কোনো আনন্দের কাজ করেছে। আর তারা সেই আনন্দকে ছড়িয়ে দিতে চায় সাধারণের মাঝে। ঠগিদের মধে৵ খুন করার আনন্দ, খুনের দৃশ্য দেখার আনন্দের কথা মনে পড়ে যায় এসব দেখে।
দেশের যেখানে–সেখানে এখন এমন খুনের ঘটনা চলছে। সাধারণ কথা–কাটাকাটি নিয়েও মানুষ মানুষকে খুন করছে। এই তো কয়েক দিন আগে কিশোরগঞ্জে ইটনায় মসজিদে তবারক বিতরণকে কেন্দ্র করে মো. ওহাব ভূঁইয়া (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
হাস্যকর হলেও সত্যি যে মাস কয়েক আগে (এপ্রিল) সুনামগঞ্জে ঘোড়ায় লাথি মারাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মারামারিতে অন্তত দুজন নিহত হন। পত্রিকার সূত্রমতে জানা যায়, জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার থলেরবন্দ গ্রামের শের আলীর গৃহপালিত ঘোড়া একই গ্রামের আশিক মিয়ার ছেলে ফরিদকে লাথি দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে রাত ১২টার দিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে দুজন নিহত হন।
গত ২৮ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায় ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধে৵ অন্তত ১৫টি ঘটনা নিতান্তই তুচ্ছ বিষয় থেকে ঘটেছে। এসব ঘটনার মধে৵ মুঠোফোনে জোরে কথা বলা থেকে শুরু করে ছেলেসন্তান না হওয়া, আসবাবের নকশা করে না দেওয়া, কথিত কিশোর গ্যাংয়ের বড়-ছোট দ্বন্দ্ব ইত্যাদি পর্যন্ত রয়েছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে মা কর্তৃক নিজের সন্তানকে পর্যন্ত খুনের ঘটনা ঘটছে। এপ্রিল মাসেই পটুয়াখালীর বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের রামবল্লভ গ্রামে নিজ সন্তানকে হত্যা করেন এক মা; এবং তার এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন শিশুটির চাচা। পুলিশ বলছে, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তাঁরা এ কাজ করছেন।
ওপরে যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলো, এসব প্রতিদিন ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনার গুটিকয় মাত্র। আসলে বাংলাদেশ এখন এক অসহিষ্ণু সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে। অতি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেও মানুষ মানুষকে খুন করতে দ্বিধান্বিত হচ্ছে না; কিন্তু প্রশ্ন তো জাগতেই পারে—কেন এমনটি হচ্ছে বা ঘটছে? এককথায় হয়তো এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অনেকেই একমত হবেন যে এই সবকিছুই ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়ের ফসল। আর সামাজিক অবক্ষয় তো এমনি এমনি ঘটে না, এর পেছনেও কারণ থাকে। রাজনৈতিক অবক্ষয় সামাজিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে।
আমাদের দেশে গত কয়েক দশক ধরে নয়া পুঁজিবাদী ধারার অবক্ষয়িত রাজনীতি তার নিজের স্বার্থেই সামাজিক অবক্ষয়কে পথ দেখিয়ে চলেছে। মানুষের চোখে ঠুলি দেওয়ার জন্য চকচকে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, সামাজিক উন্নয়নকে সেই অর্থে কোনোই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
শিক্ষা নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতিতে ‘ভাই কালচার’ যা কিশোর গ্যাংয়ের মতো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করে চলেছে। সুস্থ কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই দেশের কোথাও, নেই কর্মসংস্থান। বেকারত্বের কারণে যুবসমাজের মাঝে বাড়ছে হতাশা, বাড়ছে মাদকাসক্তি। এসব কারণে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধ, শতাব্দীপ্রাচীন সামাজিক সম্পর্ক।
এক সর্বগ্রাসী ‘আমিত্ববোধ’ আমাদের গ্রাস করে চলেছে, যার অনিবার্য পরিণতিতে মানুষ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। অন্যদিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কিছু মানুষ এই অবস্থাটার সুযোগ নিচ্ছে। ফলে দেশে গড়ে উঠছে এক নির্মম ‘ঠগি সংস্কৃতি’। কোথাও কোথাও মানুষ মেতে উঠছে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো খুনের আনন্দে, খুন দেখার আনন্দে। এর ফল যে সুখকর হওয়ার নয়, তা তো বলাই বাহুল্য।
মোশতাক আহমেদ সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক