বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৮ হাজার ৭৯২ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫০ জন। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসেই শারীরিক-মানসিকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫২০ নারী ও কন্যাশিশু। গত বছর মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে দেখা গেছে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ।
সরকারি হিসাবেই এ দেশের ৭২ শতাংশ নারী তাঁদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এ দেশে ৯৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে এবং ৮২ শতাংশ নারী জনসমাগমস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হন।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৫৩ শতাংশই এ দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হন।
অনেকেই বলেন, আগের তুলনায় বেড়েছে নারী নির্যাতন। অনেকে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, আগেও ব্যাপক হারে ছিল নারী নির্যাতন। পার্থক্য হলো এখন মানুষের সচেতনতা বাড়ায় এবং তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে নির্যাতনের ঘটনা আমরা জানতে পারছি অনেক বেশি। তবে নির্যাতনের ধরন ও ভয়াবহতা যে বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। স্বীকার করতেই হবে, এ দেশে নারী নির্যাতন আছে এবং অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবেই আছে। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ এই চিত্র প্রায়ই আমাকে যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করায়, তা হলো নারীর প্রতি পুরুষের ঘৃণা ও বিদ্বেষ কি দিন দিনই বাড়ছে? না হলে নারীরা কেন এত বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন? নারীর উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করে পুরুষ কি তাঁর অবস্থান নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত? নারী কি তবে পুরুষের প্রতিপক্ষ? প্রশ্ন হলো নারীর প্রতি পুরুষের এই ভয় আর ঘৃণার উৎপত্তি কোথায়?
ফলে নারীর প্রতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসবে তারা। মনে রাখতে হবে, পুরুষতন্ত্রের চর্চা ও তা রক্ষার দায় পুরুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পেশিশক্তি প্রদর্শন না করেও যে পুরুষ হওয়া যায়, সেটি বোঝার সময় হয়েছে এখন। সময় হয়েছে ‘পুরুষ’ শব্দটির ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার।
যে মাতৃগর্ভে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক পুরুষের উৎপত্তি, সেই পুরুষ কী করে নারীর প্রতি এতটা সহিংস আচরণ করতে পারে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যে সমাজকাঠামো এবং পারিবারিক চর্চার মধ্য দিয়ে ছেলেসন্তানদের বড় করি, সমস্যা মূলত সেখানেই। লন্ডনভিত্তিক ‘মেনজ সেন্টারের’ প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং একাধারে লেখক, চিকিৎসক ও গবেষক অ্যাডাম জিউকস তাঁর বিখ্যাত হোয়াই মেন হেট উইমেন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের পথ পরিক্রমায় একজন ছেলের পুরুষ হয়ে ওঠার যে সামাজিক প্রক্রিয়া, মূলত সেটিই পুরুষকে কর্তৃত্ববাদী, কঠোর এবং সহিংস করে তোলে।
এই প্রক্রিয়ায় অনেক পুরুষ নিজেদের অজান্তেই নারীকে ঘৃণা করতে শেখে এবং তাঁদের প্রতি সহিংস আচরণ করেন। এই প্রক্রিয়া যে সমাজে যত প্রবল, সে সমাজের পুরুষেরা নারীর প্রতি তত বেশি হিংস্র ও অমানবিক। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে ‘মিসোজিনি’। এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে মূলত নারীর প্রতি পুরুষের ঘৃণার ধারণা প্রকাশের জন্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ এবং চর্চার মধ্যে জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা। এই অনুভূতি দ্বারা শুধু যে পুরুষ আক্রান্ত হন, তা কিন্তু নয়। নারীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হন।
অ্যাডাম জিউকস তাঁর গবেষণায় আরও উল্লেখ করেছেন, সমাজে আমরা নারীদের মূলত সেবাদানকারীর ভূমিকাতেই দেখি। মা তার আপন গণ্ডিতে তিল তিল করে বড় করতে থাকেন সন্তানদের। সেখানে থাকে কেবলই সেবা, আদর আর ভালোবাসা। কিন্তু কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে এসে ছেলেসন্তানটি মায়ের গণ্ডির বাইরের অধিকাংশ পুরুষকে ভিন্ন আচরণ করতে দেখে। সে বুঝতে পারে, বাইরের পুরুষেরা তার চেয়ে আলাদা। সেই পুরুষদের প্রায় সবাই শক্তিশালী, কর্তৃত্ববাদী এবং আধিপত্যবাদী। এই আচরণগুলো পর্যবেক্ষণ করে মায়ের গণ্ডির ভেতর সে একধরনের একাকিত্ব বোধ করতে শুরু করে এবং গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করে। সে বুঝতে শেখে পুরুষের কঠিন রূপটির সঙ্গে অভ্যস্ত না হলে সমাজ কখনো তাকে পুরুষ হিসেবে মেনে নেবে না।
ফলে পরিবর্তন তার জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। এত দিন পরম নির্ভরতার মাঝে বেড়ে ওঠা মায়ের সেই বৃত্তটিকেই পুরুষ হওয়ার পক্ষে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয় তার এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণে চেষ্টা করে সে। প্রক্রিয়াটি কিন্তু মোটেই সহজ নয়। পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় তার কৌশল হয়ে ওঠে শক্তির প্রয়োগ আর কর্তৃত্ববাদী আচরণ। অনেক ক্ষেত্রে অপারগতার গ্লানি থেকে জন্ম নেয় ঘৃণা।
সমাজে পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হতে অনেকেই নারীর প্রতি সহিংস আচরণের কৌশলটি বেছে নেয়। কারণ, পুরুষ তার পর্যবেক্ষণে নারীকেই সমাজে দুর্বল অবস্থানে দেখতে পায় এবং সেই দুর্বলের প্রতি সহিংস আচরণ করার মাধ্যমেই সমাজে নিজেকে পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে সে। তবে পরিবারের সন্তানদের সহিংস হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারে সহিংসতার চর্চা অন্যতম বড় ভূমিকা রাখে। শুধু পরিবার ইতিবাচক হলেই হবে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যদি ভিন্ন রকম চর্চা থাকে, সেটিও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে।
পরিস্থিতির উত্তরণে প্রথমেই যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন গবেষকেরা, তা হলো নারী ও পুরুষের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকার দৃশ্যমান পার্থক্য না থাকা। সন্তানের প্রথম ও প্রধান সেবাদানকারী হিসেবে শুধু মা কিংবা নারীর উপস্থিতি, পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে সন্তানকে অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক ধারণা দেয়। তাই সন্তানের সেবাদানকারী হিসেবে পুরুষের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ খুব জরুরি। এতে পুরুষের কমনীয় ও স্নেহশীল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি সন্তানের সামনে স্পষ্ট হবে এবং ছেলেসন্তানেরা কঠিন ও সহিংস পুরুষ হওয়ার তাড়না থেকে বের হয়ে আসবে।
ঠিক একইভাবে প্রারম্ভিক, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে একচেটিয়া নারী শিক্ষক বা সেবাদানকারীর অংশগ্রহণের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সেখানে পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চশিক্ষা স্তরে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এবং পেশায় নারী–পুরুষের ভারসাম্য ও সমতাপূর্ণ অবস্থান ও ভূমিকা নারীকে পুরুষের চোখে শক্তিশালী করবে।
ফলে নারীর প্রতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসবে তারা। মনে রাখতে হবে, পুরুষতন্ত্রের চর্চা ও তা রক্ষার দায় পুরুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পেশিশক্তি প্রদর্শন না করেও যে পুরুষ হওয়া যায়, সেটি বোঝার সময় হয়েছে এখন। সময় হয়েছে ‘পুরুষ’ শব্দটির ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার।
● নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী