যে কারণে আমি এই নতুন কারিকুলামের বিপক্ষে

২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে একমুখী সমন্বিত শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে এই পদ্ধতি ২য়, ৩য়, ৮ম ও ৯ম এবং ২০২৫ সালে এটি ৪র্থ, ৫ম ও ১০ম শ্রেণিতে চালু হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পদ্ধতি চালু হবে উচ্চমাধ্যমিকে।

নতুন কারিকুলাম দেখে মনে হয় আমরা যেন এক ইউটোপিয়ান জগতের বাসিন্দা। বাস্তবের সঙ্গে পরিকল্পনার কোনো সংযোগ নেই। একলাফে গাছের মগডালে ওঠার চিন্তা করা মানে হলো, পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার পথ বেছে নেওয়া। নতুন কারিকুলাম যেন তেমনই এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত—কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলার নামান্তর।

বাংলাদেশের জন্ম থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিশনের ছিল নিজস্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সব শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢাকা শহরের রাস্তার মতো। খোঁড়াখুঁড়ি যেন শেষই হয় না।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়েছে, প্রমত্ত পদ্মার ওপর সেতু নির্মিত হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল তৈরি হয়েছে, ঢাকা শহরে ব্যয়বহুল মেট্রোরেল চালু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর এতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও এই দেশ নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর, টেকসই ও পরিচ্ছন্ন শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে পারেনি।

নতুন কারিকুলাম ফিনল্যান্ডের মডেল ফলো করে তৈরি করা হয়েছে, এমনটি আলোচনায় দেখতে পাই। কিন্তু বিদেশি প্রযুক্তিতে নির্মিত মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু কিংবা কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ শুরুর আগে বাংলাদেশের ভূমিরূপ নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়েছে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মনগড়া শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার আগে একবারও কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আমাদের সক্ষমতা এবং এই কারিকুলামের ভবিষ্যৎ সফলতা বিবেচনা করেছেন?

বর্তমানে কারিকুলাম নিয়ে হযবরল অবস্থা বিবেচনা করলে সহজেই অনুমেয় যে কারিকুলাম চালু করার পূর্বে আমাদের সক্ষমতা এবং তার ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়ে কোনো রকম গবেষণা করা হয়নি। খেলার মাঠ প্রস্তুত না করে, খেলা পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রেফারি নিয়োগ না দিয়ে একদল খেলোয়াড়কে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিলে সারা দিন বল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলবে ঠিকই, গোল হবে না কোনো দিন। কারণ, গোল করার জন্য প্রয়োজন সঠিক নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তুত করা গোলপোস্ট সংবলিত একটি খেলার মাঠ। নতুন কারিকুলাম ও অভিভাবকদের উদ্বেগ দেখে মনে হচ্ছে মাঠ প্রস্তুত না করেই বল হাতে বাচ্চাদের খেলার মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে খেলোয়াড় নামক শিক্ষার্থীরা দিশাহারা, হতাশ অভিভাবকগণও।

নিজেদের সক্ষমতা যাচাই না করে, শিক্ষকের মান, পর্যাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা বিবেচনা না করে আলু ভর্তা, ডাল রান্নার মতো ব্যবহারিক বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা শুধু বোকামিই নয়, অনৈতিকও বটে। এটা ছাত্র–শিক্ষক উভয়ের জন্যই যন্ত্রণাদায়ক। কারণ, কোনো ব্যবহারিক বিষয়ের পাঠদানের ক্ষেত্রে ছাত্র–শিক্ষকের অনুপাত হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৩০: ১। এর বেশি হলে একজন শিক্ষকের পক্ষে সামাল দেওয়া বা তদারক করা সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে বিদ্যালয়ে না আছে কিচেন, না আছে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক। ফলে আলু ভর্তা কিংবা ডাল রান্নার বিষয়গুলো বাড়ির কাজ হিসেবে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এমনও দেখা যাচ্ছে, স্কুল প্রাঙ্গনেই বসে গেছে রান্নাবান্নার আয়োজন। এতে শিক্ষক–শিক্ষার্থী উভয়েরই অংশগ্রহণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ নিয়ে নানা আলোচনা–সমালোচনা, হাসি–ঠাট্টা সবই চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম যেন রীতিমতো এক তামাশায় পরিণত হয়েছে।

নতুন কারিকুলামে কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তার পরিবর্তে আছে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন ও প্রজেক্টনির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্টের সংযোজন অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতির জায়গায় একধরনের বৈপ্লবিক চিন্তাও বটে। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টে মোট নম্বরের ২৫ শতাংশের বেশি থাকা উচিত নয়। সেই সঙ্গে প্রজেক্টভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শ্রেণিশিক্ষকের পর্যবেক্ষণ আবশ্যক। কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীকে যেসব বিষয়ে মূল্যায়ন করা হবে, তা বাড়ির কাজ হিসেবে ফেলে রাখা যাবে না। কেননা, এতে শিক্ষার্থীর প্রজেক্ট অভিভাবকদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যা ছাত্র মূল্যায়নের জন্য অনৈতিক। সুতরাং, মাথাব্যথা হলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা না করে একেবারে মাথা কেটে বাদ দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বটে।

মুখস্থ খারাপ, যদি তা শিক্ষার্থীর মননশীলতার পরিপন্থী হয় ও তার সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করে। অন্যদিকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখস্থ করার স্কিল অতীব জরুরি। যেমন গুণ ও ভাগের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার জন্য নামতা মুখস্থ রাখা খুব জরুরি। একইভাবে ব্যাকরণের নিয়ম বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর শিক্ষার্থীর সক্ষমতা যাচাই করার মাধ্যম হলো পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা। এমনকি কানাডার শিক্ষাব্যবস্থায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে বানান, শব্দার্থ, বাক্য গঠন, ব্যাকরণ, গাণিতিক সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অতএব, এই ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই প্রতি মাসে অন্তত একটি করে পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত। শিক্ষার্থীদের ওপর মুখস্থ করার চাপ কমাতে গিয়ে পরীক্ষার পদ্ধতি তুলে দেওয়া হলে উচ্চতর শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষার পদ্ধতি তাদের মধ্যে পরীক্ষার ভীতি তৈরি করবে। তারা ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে।

নতুন কারিকুলামের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিভাগ পছন্দের সুযোগ তুলে দিয়ে একমুখী শিক্ষা চালু করা। বস্তুত, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটা পিরামিডের মতো। এই পিরামিডের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে প্রাক্‌-প্রাথমিক বা প্রাথমিক শিক্ষা এবং উচ্চতর স্তরে রয়েছে মাস্টার্স ও পিএইচডি। প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী যত ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকবে, তাকে ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর সমস্যার সমাধান করতে জানতে হবে। ফলে প্রাথমিকে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শতভাগ শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। একইভাবে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক।

প্রতিটি স্তরেই অনেক কিছু শিক্ষার্থী ঝরে যায় বা পিছিয়ে যায়, অনেকে এগিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ভাগ হয়ে পড়ে। সেভাবে তারা উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোনো একটি একক বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন শুরু থেকে তার ভিত্তি মজবুত করে গড়ে তোলা। সেই বিবেচনায় একমুখী শিক্ষা কখনোই মেধা যাচাইয়ের উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে না। কেননা, একমুখী শিক্ষার ফলে যোগ্য ও অধিক যোগ্য শিক্ষার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে সুযোগ পায় না। আর কম যোগ্য বা পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে পড়ে বড় বোঝা বা চাপ। অর্থাৎ একমুখী শিক্ষা অধিকতর মেধাবীদের অবমূল্যায়ন আর কম মেধাবীদের অতি মূল্যায়নের পদ্ধতি।

শিক্ষামন্ত্রীর এক বক্তব্য থেকে জানতে পারলাম নতুন কারিকুলাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশনের ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাবে, একটা বিশেষ শ্রেণি-শ্রমিক শ্রেণি তত বেশি চাকরি হারাতে থাকবেন। প্রাচ্যের শ্রমবাজারের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দখলে। অনুমান করা যায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অটোমেশনের বহুল প্রচলন এবং ব্যবহারের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ধীরে ধীরে রোবটের দখলে চলে যাবে। ধীরে ধীরে ঘর-গৃহস্থালির কাজে মানুষের জায়গা রোবট দখল করে ফেলবে। ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বেশিসংখ্যক শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করা মানে একটা বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রজন্মকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া।

বিপরীতক্রমে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চ্যালেঞ্জ হলো মানুষ ও রোবটের বুদ্ধিমত্তায় কে টিকে থাকবে, সেই বিষয়ের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি করণীয় হলো নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে আরও বেশি শাণিত করা, একটি বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল জাতি তৈরি করা। বর্তমান কারিকুলাম দিয়ে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করা যাবে ঠিকই, বড় বড় বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী একটি উন্নত প্রজন্ম তৈরি করা যাবে না। অন্যের দাসে পরিণত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে বেকারত্ব বাড়ানো নিজেদের জন্য আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছু নয়।

অতএব, আমাদের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। একটি বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল জাতি বিনির্মাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একমুখী শিক্ষা চালু করার বিপক্ষে আমার অবস্থান। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত করার লক্ষ্যে ৯ম শ্রেণিতে পূর্বের মতো বিষয় বাছাই করার পদ্ধতি চালু রাখাটাই হবে অধিক যুক্তিসঙ্গত। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নবম শ্রেণিতে বিষয়ভিত্তিক পছন্দের সুযোগ তৈরি করে বাণিজ্য এবং মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সাধারণ বিজ্ঞান পাঠের ব্যবস্থা চালু রাখা।

শুরুতে বলেছিলাম একলাফে গাছে ওঠার পরিকল্পনা আত্মঘাতী। আমাদের এখনই এই আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সঠিক এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু করার পূর্বে নিজেদের সক্ষমতা পর্যালোচনা করা জরুরি। শিক্ষকদের অন্তত এক বছরের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ। প্রাথমিকে যেন আর একজনও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সন্তানেরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো রকম ছেলেখেলা নয়।

  • নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা
    ই-মেইল: nsultana79ju@gmail.com