মতামত

ব্রিকসে যোগদান আদৌ কি কোনো সম্ভাবনা তৈরি করবে?

২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্রিকসের দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়
ছবি: এএফপি

বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রিকস জোটের দেশগুলোর মিলিত হিস্যা ইতিমধ্যে জি-৭-এর অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। অনুমান করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রিকস বিশ্ব জিডিপির অর্ধেকের বেশি অবদান রাখবে। সম্প্রসারণ না করেও ব্রিকস দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বে ৪২ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্যে ব্রিকস দেশগুলোর অবদান ১৮ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো ব্লকটিতে যোগ দিলে বৈশ্বিক জিডিপি ও বাণিজ্যে ব্রিকসের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় ব্রিকস জোটে (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) যোগদান কোনো দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে।

এই উদীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক বৃহত্তর বাজারে প্রবেশ, বিনিয়োগের সুযোগ এবং প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এনে দিতে পারে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উদ্দীপিত করার সক্ষমতা রাখে।

একটি বহুপক্ষীয় বিশ্বের নতুন মেরুকরণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দেবে, তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে স্পষ্ট করা দরকার যে ব্রিকস বাংলাদেশের রপ্তানি নয়, মূলত আমদানির উৎস। ব্রিকসের দেশগুলো থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ৩৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তুলনায় রপ্তানি মাত্র মাত্র ৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মাত্র। ইউরোপের সাত ভাগের এক ভাগ। ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশ শুধু পোশাক রপ্তানি করেছে ২২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের।

এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), যাবতীয় আর্থিক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, উন্নয়ন এবং অবকাঠামো ঋণের সিংহভাগ এবং সর্বোপরি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রায় সব উৎসই ব্রিকসবহির্ভূত দেশে। বাংলাদেশ মূলত ব্রিকসের দুই দেশ—ভারত ও চীনের বড় রপ্তানি বাজার। তাই ব্রিকসে যোগ দিয়ে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার অতি আশা নিষ্ফল হতে পারে।

ব্রিকস থেকে সুফল তোলার সবচেয়ে বড় বাধা অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যঘাটতি, যেখানে আমদানি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি, সেখানে ব্রিকসের সুবিধা আদায়ে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দেশের সীমিতসংখ্যক পণ্যের রপ্তানি সক্ষমতা গ্রুপের বৃহত্তর অর্থনীতির সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতাকে কঠিন করে তুলতে পারে। পাশাপাশি মূল ভয় হচ্ছে আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে পারে এবং সম্ভাব্য বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশ যদি সত্যি সত্যিই বৈশ্বিক কিংবা আঞ্চলিক সংযোগকে গুরুত্ব দিত, তাহলে আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি—দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসিইপি) যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে দেখতাম। কেননা, আরসিইপি চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হলে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে তীব্র রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পড়বে।

বাংলাদেশ এখনো কারও সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ করতে পারেনি। আরসিইপি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হলে শুল্ক কমাতে হবে এবং তাতে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এই আশঙ্কায় ভারত নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। বোঝাই যাচ্ছে, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বিষয়ে উদারতার অভাব আছে। তদুপরি চীনে ৯৭ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা এখনই পাচ্ছে বাংলাদেশ, ফলে চীন থেকে নতুন কোনো বাণিজ্যসুবিধা আসার মতো নেই। ব্রিকসের অপরাপর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সীমিত।

হ্যাঁ, কিছু ঋণ হয়তো পাবে। তবে বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবির ঋণজাত উন্নয়ন ও অবকাঠামো প্রকল্পের তুলনায় ভারত ও চীনা ঋণে সম্পাদিত উন্নয়নকাজের গুণমান কম, ধীরগতির, পরিবেশগত সমীক্ষায় প্রশ্নযুক্ত। বহুপক্ষীয় মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিবদ্ধ অডিট থাকে না বলে ভারতীয় ও চীনা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ বেশি ওঠে, থেকে যায় আন্ডার টেবিল নেগোসিয়েশনের অস্বচ্ছতা।

অর্থাৎ ব্রিকস থেকে সুফল তোলার সবচেয়ে বড় বাধা অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যঘাটতি, যেখানে আমদানি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি, সেখানে ব্রিকসের সুবিধা আদায়ে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দেশের সীমিতসংখ্যক পণ্যের রপ্তানি সক্ষমতা গ্রুপের বৃহত্তর অর্থনীতির সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতাকে কঠিন করে তুলতে পারে। পাশাপাশি মূল ভয় হচ্ছে আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে পারে এবং সম্ভাব্য বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

অন্য সমস্যা আর্থিক সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতি বলে দেশের সীমিত আর্থিক সংস্থান ব্রিকস সদস্যপদের সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কঠিন করে তুলতে পারে। সদস্যপদ বকেয়া, যৌথ উদ্যোগে অবদান এবং উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ দেশের আর্থিক অবস্থাকে চাপে ফেলতে পারে এবং ঋণের বোঝা বাড়াতে পারে।

বড় সমস্যা ঋণের উদ্বেগ। ব্রিকসে যোগদানের ফলে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য ঋণের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে বা ব্রিকসের আর্থিক বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণের শর্তে অধিক ঋণ নিয়ে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারে, তখন ঋণের স্থায়িত্ব এবং পরিষেবা দীর্ঘ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। বিশেষ করে যদি ধার করা তহবিল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা না হয়।

অর্থনীতির পাশাপাশি বড় উদ্বেগ এই যে, ব্রিকস একনায়ক, কর্তৃত্ববাদী শাসন কিংবা হাইব্রিড সরকারগুলোর বলয় হয়ে উঠছে। ব্রিকস দেশগুলোয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন এবং দুর্নীতিতে সরকারি উৎসাহের অভিযোগ প্রকট। ফলে ব্রিকসের কাজে কতটা আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ করা হবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে, সেটা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতা একটা বড় বিষয়। বাংলাদেশের শিল্প ও উৎপাদন খাতগুলো ব্রিকসের মধ্যে বৃহত্তর অর্থনীতি থেকে বাড়তি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে, যা স্থানীয় শিল্পকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, বিকাশের সম্ভাবনাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অক্ষম হয় বা প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান, সংস্কার এবং প্রযুক্তির জোগান যথাসময়ে না হয়। অর্থাৎ মানের বিপরীতে উৎপাদন খরচের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাধা থেকে যাবে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ব্রিকস হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ রপ্তানি বাজার। যেসব দেশ পণ্য উৎপাদনে কম খরচে ইনোভেশন আনতে পারবে, তারা এই বৃহৎ বাজারে ভালো করবে। ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর যথেষ্ট বিনিয়োগের ক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সহায়তা করার জন্য মূলধন, দক্ষতা এবং প্রযুক্তি আনতে পারে।

এটি শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে। ব্রিকস আধুনিক খাদ্য ও কৃষি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, শিল্প-প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রগুলোতে জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া, নীতি সমন্বয় এবং যৌথ উদ্যোগকে সহজতর করতে পারে। ব্রিকস দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগ এবং প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণ এবং আঞ্চলিক সংযোগ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য নতুন কোনো সদস্য দেশকে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

তারপরও অর্থনীতির পাশাপাশি বড় উদ্বেগ এই যে, ব্রিকস একনায়ক, কর্তৃত্ববাদী শাসন কিংবা হাইব্রিড সরকারগুলোর বলয় হয়ে উঠছে। ব্রিকস দেশগুলোয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন এবং দুর্নীতিতে সরকারি উৎসাহের অভিযোগ প্রকট। ফলে ব্রিকসের কাজে কতটা আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ করা হবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে, সেটা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচিত হবে, তার প্রধান প্রধান রপ্তানি রেমিট্যান্স উৎস দেশকে বিব্রত ও বিরক্ত না করেই সাধারণ সদস্যপদ নেওয়া এবং কোনো বিষয়ে অত্যুৎসাহী না হওয়া, যাতে করে আমাদের রপ্তানি বাজারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। গভীরতর সমীক্ষা না করে, শুধু নতুন ঋণের বাড়তি উৎস তৈরির চেষ্টা তাই অর্থহীন। কেননা, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিদেশি ঋণ গ্রহণের বিপৎসীমা পার করছে বা করে ফেলেছে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য

    faiz.taiyeb@gmail.com