মতামত

কাটছাঁটে ‘সবার আগে শিশু’ নয়

করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের যখন স্কুল-কলেজে ফিরিয়ে আনাটাই চ্যালেঞ্জ, তখন তাদের খাওয়া বন্ধ রাখার পরামর্শ ঠিক পরামর্শ নয়।
ফাইল ছবি

চলতি সংকটে অর্থনীতির মেরুদণ্ডটা সোজা রাখার নানান চেষ্টা চলছে। খরচ কমানোর চেষ্টায় চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাই বলে কি খরচ কমানোর কাঁচি শিশুদের দিয়েই শুরু করতে হবে?

সব ক্ষেত্রে ‘সবার আগে শিশু’ নীতি যে ভালো নয়, এটিও তার একটি নজির। শিশুর খাবার খরচ নাকি বিনিয়োগ, সে তর্ক কুতর্কের নামান্তর। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, খরচ কমানোর তালিকায় ধাপে ধাপে যুক্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের জন্য রাখা বরাদ্দ। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০২১ সালের ১ জুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার হিসেবে খিচুড়ি দেওয়ার ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাতিল করে দেয়।

এ সময় একটি ইংরেজি দৈনিককে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম বলেছিলেন, ‘স্কুলে খাওয়ানোর কর্মসূচি আবার চালু করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।’ কর্মসূচিটি কেন আর চালানো হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

সম্প্রতি খরচ কমানোর খড়্গ পড়েছে সরকারি শিশু-কিশোর ক্লাবগুলোর ওপর। সরকারের দাবি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট ৪ হাজার ৮৮৩টি (৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন ও ৩৩০টি পৌরসভার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে) ক্লাব আছে (বলে রাখা ভালো, ‘কাজির কিতাবের’ হিসাব আর মাঠের হিসাব সব সময় এক হয় না)।

সেখানে সপ্তাহে ২ দিন মোট ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯০ জন শিশু এবং কিশোর-কিশোরী বিনোদনের জন্য আসে। তারা আবৃত্তি, গান ও কারাতে চর্চা করে; বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। সভায় এলেই তাদের নাশতা দেওয়া হতো। জনপ্রতি ৩০ টাকার নাশতা দেওয়া হতো। সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

১৯ অক্টোবর ২০২২ প্রথম আলো বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ব্যয় কমানোর অজুহাতে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্প থেকে শিশুদের নাশতা বন্ধ করে দেওয়ায় শিশুদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে।

ক্লাবে আসা কমে গেছে। এক শিশু-কিশোর সংগঠক বলেছেন, নাশতা দিয়ে ক্লাবে আনার বিষয়টি তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। খাবারের লোভ দেখিয়ে শিশু-কিশোরদের সংগঠন গড়ে তোলা যায় না। তাঁর মতে, শিশুরা আসবে মনের আনন্দে। তিনি মনে করেন, শিশু-কিশোরদের আকর্ষণ করার মতো কর্মসূচি থাকতে হবে।

খাবারের চেয়ে কর্মসূচির মজা শিশুদের বেশি টানে। তারপরও তাঁর কথা, ‘সীমিত আয়ের মানুষ এখন এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এত কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি কেউ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে শিশুরা যাতে ক্ষুধার্ত না থাকে, সেদিকে আমাদের বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। কোনো অজুহাতে সপ্তাহে দুই দিন এ সামান্য খাবার বন্ধ না করে বরং পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।’

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আংশিক কাজ হয়েছে। এক দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় হিসাব-নিকাশ করে খরচ অর্ধেক কমিয়ে আগামী আড়াই মাস নাশতা চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ৩০ টাকার নাশতা পাওয়া যাবে না। ১৫ টাকায় তা সারতে হবে। একটা সেদ্ধ ডিম আর একটা পাকা কলা কি এই পয়সায় সম্ভব?

চর দেখতে, মসলার চাষ শিখতে, মেডিকেল যন্ত্রপাতির প্রশিক্ষণ নিতে, শিশুদের পড়াশোনা শেখানোর কৌশল শিখতে বিদেশ সফর অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের চরের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা যায়, তা দেখতে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০ সরকারি কর্মকর্তা। নয়জন এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন, বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায়।

অন্য খাতে কৃচ্ছ্রের খবর কী

গত ২০ জুলাই সরকার নানান কৌশলের পাশাপাশি কৃচ্ছ্রসাধনের যে আটটি কায়দার কথা বলেছিল, এর মধ্যে ছিল সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, জ্বালানি খাতে সরকারের বাজেটের ২০ শতাংশ কম ব্যবহার, অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ সফর পরিহার করা, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মজুতদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি। বিদেশ সফর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ, গাড়িবিলাস ইত্যাদিতে লাগাম টানার কথা থাকলেও দৃশ্যমান পরিবর্তন নজরের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

চর দেখতে, মসলার চাষ শিখতে, মেডিকেল যন্ত্রপাতির প্রশিক্ষণ নিতে, শিশুদের পড়াশোনা শেখানোর কৌশল শিখতে বিদেশ সফর অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের চরের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা যায়, তা দেখতে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০ সরকারি কর্মকর্তা। নয়জন এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন, বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায়।

এসি-সুখ কমেনি

১৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একনেক সভায় সভাপতিত্ব করার সময় গরমের মধ্যে অফিসে স্যুট-কোট না পরতে অনুরোধ করেছিলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি এটা তাঁর পুরোনো নির্দেশনা। বারবার মনে করিয়ে দিয়েও তিনি যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। সম্প্রতি ডয়চে ভেলে রেডিওতে প্রচারিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এসি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নেই, মন্ত্রণালয়ের নানা দপ্তরে এ রকম ৮০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর রুমে এসি চলছে বহাল তবিয়তে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৈনিক ভ্রমণ ভাতা ও বদলি ভাতা বাড়ানো হয়েছে।

খরচ কমাতে লাগাম টানার খাত

একেবারেই খরচের লাগাম টানার কাজ শুরু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। ইতিমধ্যে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। যেমন নদী খনন, গ্রামীণ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রভৃতি। ভর্তুকি কমানো হয়েছে সার, ডিজেলে। এগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। নদী খনন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এক বছর ফেলে রেখে অন্য বছর পুষিয়ে দেওয়ার মতো কাজ নয় এটা।

করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের যখন স্কুল-কলেজে ফিরিয়ে আনাটাই চ্যালেঞ্জ, তখন তাদের খাওয়া বন্ধ রাখার পরামর্শ ঠিক পরামর্শ নয়। গত বছরের চেয়ে এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৮৩ পরীক্ষার্থী কমেছে। মাধ্যমিকে কমেছিল ৮৭ হাজার ৫৫৪ পরীক্ষার্থী। তথ্য বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকলে জানা যেত, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা ছেড়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা কোন অর্থনৈতিক শ্রেণির ছিল।

তবে এরা যে বিত্তশালী পরিবারের নয়, তা অনুমান করতে বাধা নেই। অর্থনৈতিক চাপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য খরচ কমাতে হবে। তবে কোন খাত থেকে কমালে শিশু, কিশোর, কিশোরীদের সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে, সেটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। শিশুদের জন্য বরাদ্দ খরচ নয়, বিনিয়োগ।

জাতিসংঘ থেকে নবজাতক শিশুর মা পর্যন্ত সবাই মনে করে, শিশুকেই সবার আগে পাত্তা দিতে হবে। সুসময়ে, অসময়ে, সংকটে, সংগ্রামে কখনোই তাকে হেলাফেলা করা যাবে না। তাকে ক্ষুধার্ত রাখা যাবে না।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক, গবেষক। ইমেইল: nayeem5508@gmail.com