উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির ডামাডোলের মধ্যেই অনিরাপদ কর্মপরিবেশে নিয়মিত অকালমৃত্যু ঘটছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের। পরিবহন, নির্মাণ, শিল্প, কৃষি, দিনমজুর, ইস্পাত, জাহাজভাঙা, পাথরভাঙা ইত্যাদি কোনো খাতেই শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই। দেশে কোন কোন খাতে, কী কারণে, শ্রমিকেরা নিয়মিত হতাহত হচ্ছেন, পঙ্গুত্ববরণ করছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও সরকার রাখার প্রয়োজন মনে করে না। নেই যথাযথ চিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কার্যকর প্রতিরোধের আয়োজন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর নির্ভর করে বেসরকারিভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার হিসাব করার চেষ্টা করছে, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই সব দুর্ঘটনার কথা উঠে আসার কথা নয়। এই হিসাব থেকে জানা যায়, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। আরেকটা বিষয় হলো, কর্মস্থলে সরাসরি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের কারণে প্রতিবছর ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেন বহু শ্রমিক, যার কোনো হিসাব কারও কাছেই নেই। দেশের বিভিন্ন ইটভাটা, চাতাল, করাত কল, ইস্পাত কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা, চামড়া, পাথরভাঙা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক কর্মপরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করার ফলে ঠিক কত শ্রমিক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, কত শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ধুকছেন, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না।
বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির ১৫টি জাতীয় দৈনিক ও ১১টি আঞ্চলিক দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মস্থলে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা ৭১২, যা ২০২১ সালে ছিল ৫৩৮ ও ২০২০ সালে ৪৩৩। এর মধ্যে ৪ জুন ২০২২–এ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ৫০ জন নিহত হওয়ার হিসাবও রয়েছে।
জরিপে প্রাপ্ত কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন পরিবহন খাতে, যাঁদের সংখ্যা মোট ৩৩৩। এরপরই রয়েছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে (যেমন ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) ১৭০ জন, নির্মাণ খাতে নিহত ১০৪ জন, কৃষি খাতে ৬২ জন এবং কলকারখানা ও অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে এই সংখ্যা ৪৩।
আসলে বিশ্বের যেসব দেশে তদারক সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, সেসব দেশের রাজনৈতিকেরা জনগণের সমর্থন পেতে বা ধরে রাখতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই সহজেই প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অকালমৃত্যু থামছে না।
মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫৩ জন; বিভিন্ন বিস্ফোরণে ৮৪ জন; বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৬৯ জন; বজ্রপাতে ৫৭ জন; মাঁচা বা ওপর থেকে পড়ে ৪৫ জন; শক্ত বা ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা আঘাত বা তার নিচে চাপা পড়ে ৩৮ জন; পানিতে ডুবে ২৪ জন; আগুনে পুড়ে ১৪ জন; রাসায়নিক দ্রব্য বা সেপটিক ট্যাংক বা পানির ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ১৪ জন; পাহাড় বা মাটি, ব্রিজ, ভবন বা ছাদ, দেয়াল ধসে ১৩ জন এবং অন্যান্য কারণে ১ জন শ্রমিক নিহত হন (বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রম অর্থনীতি ২০২২, সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি, জানুয়ারি ২০২৩, পৃষ্ঠা ৯)।
বেসরকারি সংস্থা ওশি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২২ সালে সারা দেশে বিভিন্ন সেক্টরে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট ৯৬৭ জন আর আহত হয়েছেন মোট ২২৮ জন শ্রমিক। এর মধ্যে পরিবহন খাতে নিহত হয়েছেন সর্বোচ্চ ৪২৫ জন শ্রমিক। ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, হোটেল বা রেস্টুরেন্ট, সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিহত হয়েছেন ২১১ জন। কৃষি খাতে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ১২৪, নির্মাণ খাতে ১০৫ জন, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিহত ৬৭ জন। তৈরি পোশাকশিল্পে নিহত হওয়ার সংখ্যা ২৮, জাহাজভাঙা শিল্পে নিহত হয়েছেন ৭ জন। ওশি ফাউন্ডেশনের হিসাবে গত এক দশকে (২০১৩-২০২২) মোট ১৫ হাজার ২৫৯ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে হতাহতের শিকার হন, যার মধ্যে ৯ হাজার ৫৫৮ জন নিহত ও ৫ হাজার ৭০১ জন আহত হন (২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে হতাহত হয়েছেন ১ হাজার ১৯৫ শ্রমিক, সমকাল, ৩০ ডিসেম্বর ২২)।
আফসোসের ব্যাপার হলো, যেসব দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে, জখমের শিকার হয়ে পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করতে হচ্ছে, তার বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন তদারক সংস্থাগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে শ্রমিক নিয়োগকারী মালিকপক্ষ বাধ্য হতো শ্রমিকদের জন্য কর্মস্থল নিরাপদ রাখতে। ফলে দুর্ঘটনা কম হতো বা হলেও এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে মরতে হতো না। উদহারণস্বরূপ, জুন ২০২২ এ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের কথাই ধরা যাক।
এই ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যেসব ভুল ও অব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো, ডিপোতে কেমিক্যালসহ বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার এবং পোশাকসহ অন্য রপ্তানিবাহী পণ্যের কনটেইনার একসঙ্গে রাখা, আল রাজী কেমিক্যাল কর্তৃক হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো বিপজ্জনক পণ্য যথাযথ মানসম্পন্ন জারে না রাখা, অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকা, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ইত্যাদি (নিয়ম মানলে এত হতাহত হতো না: বিএম ডিপোর ৪ ভুল তদন্ত প্রতিবেদনে, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অনলাইন বাংলা, ৬ জুলাই ২০২২)।
এই দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল আল-রাজী কেমিক্যাল কর্তৃপক্ষের। কারণ, এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে একইভাবে কনটেইনারে আগুন লাগার ঘটনায় মার্কস (কম্বোডিয়া) লিমিটেড এর একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড পরিবহন ও সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানার অনুরোধ জানানো হয়েছিল (সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড: কম্বোডিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের পরও সতর্ক হয়নি আল-রাজী কেমিক্যাল, ১২ জুন ২০২২, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা)।
সেই সঙ্গে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর, কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি তদারক সংস্থাগুলো লাইসেন্স দেওয়ার সময় যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করত এবং বিপজ্জনক পণ্য রাখার নিয়মকানুন সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কি না, অগ্নিনিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা আছে কি না, সেসব বিষয়ে নিয়মিত তদারক করত, তাহলেও এই ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারত না। এই কারণেই বিএম কনটেইনার ডিপোয় অগ্নিকাণ্ডের পর গঠন করা বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ডিপোর মালিকের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোকেও দায়ী করা হয় (মালিকের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোর দায় আছে, ৬ জুলাই ২০২২, প্রথম আলো)।
কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, বছর শেষ হওয়ার আগেই অগ্নিনিরাপত্তা, কারখানা পরিদর্শন, নারী ও শিশুদের নিয়োগের নীতিমালা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আটটির মতো আইন পাস করা হয়। এভাবে ১৯১৩ সাল নাগাদ শ্রম অধিকারবিষয়ক আরও ২৫টি আইন পাস করা হয় যে আইনগুলোর অনেকগুলোই পরবর্তী সময় নিউ ডিলের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় আইনে পরিণত হয়, যা পরবর্তী বছরগুলোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণির কর্মস্থলের নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মালিকপক্ষ ও সরকারি তদারক সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে শুধু বিএম ডিপোর মতো বড় দুর্ঘটনাই নয়, সড়ক দুর্ঘটনায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে, ওপর থেকে পড়ে, শক্ত বা ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা আঘাত বা তার নিচে চাপা পড়ে, আগুনে পুড়ে, বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে, পাহাড় বা মাটি, ব্রিজ, ভবন বা ছাদ, দেয়াল ধসে যত মৃত্যু ঘটে, তার বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা যেত। নির্মাণ খাতে দুর্ঘটনাগুলোর কথাই ধরা যাক। নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকের মাধ্যমে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য মাথায় হেলমেট, কোমরে সেফটি বেল্ট, পায়ে রাবারের জুতা ব্যবহার, পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য নাইলনের জাল দিয়ে পুরো নির্মাণাধীন ভবন ঢেকে দেওয়া, নির্মাণাধীন ভবনকে উঁচু বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা, ভবনের চারপাশে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে টিন দিয়ে অস্থায়ী মাচা বানানো ইত্যাদি নিয়ম মানতে মালিকপক্ষকে বাধ্য করা হলে ওপর থেকে নিচে পড়ে, বিদ্যুৎপৃষ্ঠে বা ভারী বস্তুর আঘাতে শ্রমিক ও পথচারীদের মৃত্যু অনেকাংশেই ঠেকানো যেত। একইভাবে সড়কে ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচল, লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক, চালক ও হেলপারদের যথাযথ মজুরি ও কর্মপরিবেশ, ত্রুটিমুক্ত যথাযথ ডিজাইনের সড়ক মহাসড়ক, পরিবহন মালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করা হলে সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ ও পরিবহনশ্রমিকদের মৃত্যু কমিয়ে আনা যেত।
শ্রমিক নিয়োগকারী মালিকপক্ষের দায়িত্ব হলো নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা আর সরকারের দায়িত্ব হলো মালিকপক্ষ তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে কি না, তা তদারক করা। এ জন্য সরকারের কতগুলো নির্দিষ্ট বিভাগ আছে, যেমন কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয়, তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও তাৎক্ষণিক লাভ-লোকসান বিবেচনায় অনেকেই এ বিনিয়োগটুকু করতে চান না। এ কারণেই সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক তদারক এ ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত তদারক ছাড়াও কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ রক্ষায় মালিকদেরকে বাধ্য করার আরেকটা উপায় হলো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মালিকপক্ষকে বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড দিতে বাধ্য করা এবং আইন অনুযায়ী বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হলে কারখানার মালিকদের কাছে তখন আর নিরাপত্তাজনিত ব্যয় হ্রাস করা বা নিরাপত্তায় অবহেলা করাটা লাভজনক মনে হবে না।
১৯১১ সালের ২৫ মার্চ নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট নামের একটি গার্মেন্ট কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৪৬ জন পোশাকশ্রমিকের মৃত্যু ঘটে, যাঁদের বেশির ভাগই ছিল অল্পবয়সী অভিবাসী কিশোরী ও তরুণী। ঘটনাটি ছিল মার্কিন ইতিহাসে কর্মক্ষেত্রে ঘটা সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়গুলোর মধ্যে একটি। এই ভয়ংকর ঘটনাটি নিউইয়র্কের সব নাগরিক ও শ্রম অধিকার কর্মীদের মধ্যে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যে এর ফলে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। ডেভিড ভন দ্রেহলে তাঁর ‘ট্রায়াঙ্গেল: দ্য ফায়ার দ্যাট চেঞ্জড আমেরিকা’ শীর্ষক পুস্তকে এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে ট্রেড ইউনিয়ন, সিটিজেন ইউনিয়ন, কনজিউমার লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘ফ্যাক্টরি ইনসপেকশন কমিটি’ শুধু পোশাক কারখানা নয়, ২০ ধরনের প্রায় ২ হাজার কারখানায় পরিদর্শন চালায়।
কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, বছর শেষ হওয়ার আগেই অগ্নিনিরাপত্তা, কারখানা পরিদর্শন, নারী ও শিশুদের নিয়োগের নীতিমালা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আটটির মতো আইন পাস করা হয়। এভাবে ১৯১৩ সাল নাগাদ শ্রম অধিকারবিষয়ক আরও ২৫টি আইন পাস করা হয় যে আইনগুলোর অনেকগুলোই পরবর্তী সময় নিউ ডিলের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় আইনে পরিণত হয়, যা পরবর্তী বছরগুলোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণির কর্মস্থলের নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মস্থলে নিয়মিত ঘটতে থাকা দুর্ঘটনা, শ্রমিকের মৃত্যু এবং তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ থেকে এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর নয় যে তা মালিকদেরকে কর্মস্থলে যেকোনো মূল্যে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বাধ্য করবে। এ কারণেই কিন্তু পোশাকশিল্প খাতের বিদেশি ক্রেতারা একের পর এক দুর্ঘটনায় নিজ দেশের নাগরিক অধিকারকর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে এ দেশের সরকারের ওপর ভরসা না করে নিজেরাই অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মতো সংগঠন করে পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু যেসব কারখানা বা কর্মস্থলের সঙ্গে বিদেশি ক্রেতার কোনো সম্পর্ক নেই, সেসব দেশি কারখানা ও কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ কী করে নিশ্চিত হবে যদি সরকার মালিকপক্ষকে বাধ্য না করে!
আসলে বিশ্বের যেসব দেশে তদারক সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, সেসব দেশের রাজনৈতিকেরা জনগণের সমর্থন পেতে বা ধরে রাখতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই সহজেই প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অকালমৃত্যু থামছে না।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি
ই–মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com