ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা উদার গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তাকে সফল করতে হলে আমাদের শিক্ষা সংস্কারের দিকে অবশ্যই যেতে হবে, কেননা শিক্ষা খাতই হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, নতুন নতুন পলিসি, আইডিয়া এবং চিন্তাপ্রকল্প তৈরি ও চর্চার কেন্দ্র। এ মুহূর্তে তাই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথাযথ সংস্কার করা এখন গণদাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান উৎপাদন এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিকাশের কেন্দ্রে পরিণত করতে হলে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক পদোন্নতি নীতিমালা, উন্নত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নসহ কাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠন করলেও এখনো শিক্ষা কমিশন গঠন কেন করেনি, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। যা–ই হোক, এই লেখায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের একটা রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষার্থী-শিক্ষক মতবিনিময় সভায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী মত দেন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অবনমনের একটি বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষকদের পাঠদানে অদক্ষতা, অত্যাধুনিক পাঠদানপদ্ধতির অনুপস্থিতি, ক্লাসের প্রতি যত্নবান না হওয়া এবং ক্লাসে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়ার মতো ক্রিটিক্যাল চিন্তা না থাকা। এই বিষয়গুলোর অধিকাংশই সমাধান সম্ভব যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমানে প্রচলিত মানহীন এবং পক্ষপাতমূলক শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতির বিলোপ এবং বৈশ্বিক মানসম্পন্ন একটি নিয়োগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু করাই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ। এ জন্য শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
বর্তমানে উপাচার্য এবং সহ–উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে একটি মাত্র ভাইবার ভিত্তিতে যে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্য মেধাবী শিক্ষক নিয়োগে বাধা হিসেবে কাজ করে। এ জন্য চলমান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা সংস্কার করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
তবে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে কমিটি করা হবে তাকে আগে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতা ভালো এ রকম গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকদের নিয়েই এই কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটিতে অযোগ্য লোকজন রাখলে নিয়োগে চলমান অনিয়ম চলতেই থাকবে। এই কমিটি একাডেমিক যোগ্যতা (উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি থেকে পিএইচডি থাকা) এবং গবেষণার প্রোফাইল দেখে প্রাথমিক একটা প্রার্থী তালিকা তৈরি করবে।
পরবর্তী সময়ে বিভাগীয় নিয়োগ কমিটি এবং ডিনের তত্ত্বাবধানে প্রথমে শিক্ষক পদে প্রার্থীরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সামনে নিজ নিজ গবেষণার ওপর প্রেজেন্টেশন দেবেন এবং কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ডেমো ক্লাস নেবেন, যার মাধ্যমে ক্লাসরুমে তাঁদের ক্লাস নেওয়ার দক্ষতা ও পাঠদানের কৌশল, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-জিজ্ঞাসাকে বিকশিত করা বা আগ্রহ তৈরি করার ক্ষমতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা, অংশগ্রহণমূলক ক্লাসরুম তৈরির দক্ষতা এগুলো যাচাই করা হবে। প্রেজেন্টেশন এবং ক্লাস ডেমোর পর জ্ঞান এবং স্কিলের ভিত্তিতে স্কোরিং করে দক্ষতা, যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে যাচাই করা প্রার্থীদের ফাইনাল ভাইবা উপাচার্য, সহ–উপাচার্যের তত্ত্বাবধানে হতে পারে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন জ্ঞান উৎপাদন এবং বিতরণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ত্রুটিযুক্ত শিক্ষক পদোন্নতি নীতিমালা। তাই পদোন্নতি নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। প্রমোশন সহজেই পাওয়ার কারণে অনেকেই নতুন জ্ঞান উৎপাদনে সেরকম কোনো অবদান না রেখেই অতি সহজে অধ্যাপক হয়ে যান, যা মোটেও কাম্য নয়।
অনেকেই মানহীন গবেষণাপত্র প্রকাশ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদোন্নতি নিচ্ছেন। আবার অনেকেই অধ্যাপক হয়ে যাওয়ার পর গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সাইটেশন সংখ্যা, ডিওআই জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা, জার্নাল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের টোটাল স্কোর, বনেদি জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেল সংখ্যা—এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তারপরই প্রমোশন দেওয়ার সিস্টেম চালু করলে এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে গবেষণার কালচার গড়ে উঠবে।
তবে বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চারুকলাসহ বিভিন্ন অনুষদের ক্ষেত্রে পদোন্নতির ভিন্ন ভিন্ন ক্রাইটেরিয়া বা ধরন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলা দরকার যে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে অবশ্যই মানসম্মত বেতন-ভাতা, গবেষণা ফান্ড এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ফান্ড বাড়ানো, এমফিল-পিএইচডি ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন গবেষণা ল্যাব প্রতিষ্ঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
স্বায়ত্তশাসন যেন শিক্ষকদের জবাবদিহিহীন না করে সে জন্য একটি স্বচ্ছ অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের ইভালুয়েশন পদ্ধতি চালু করে শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩–এর অধ্যাদেশের বলে একধরনের নির্বাচিত লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যেখানে জাতীয় রাজনীতির বড় দলের লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক প্যানেল (নীল, সাদা, গোলাপি দল) থেকে নমিনেশন পাওয়া শিক্ষকেরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক বডিগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন।
এসব বডিতে একসময় দুই বিবদমান ধারার ভারসাম্য থাকলেও এবং অনেক যোগ্য শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে আসতেন—এটা স্বীকার করেই বলতে হচ্ছে, এই কাঠামোতে অনেক ক্ষেত্রেই একাডেমিক দিক দিয়ে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নীতিনির্ধারণী এসব বডিতে যেতে পারেননি এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি শিক্ষক প্যানেলের অন্যায্য আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী এসব ফোরাম শিক্ষা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে যথাযথ উন্নয়ন করতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারকে ত্বরান্বিত করার টুল হিসেবে কাজ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটে ইতিপূর্বে অনেকেই নির্বাচিত হয়ে আসছেন, যাঁরা দুঃখজনক হলেও একাডেমিক দিক দিয়ে ছিলেন দুর্বল কিন্তু রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির দিক দিয়ে ছিলেন বলিষ্ঠ। এর ফলে সিন্ডিকেট ও সিনেট কোনো একাডেমিক ফোরাম না হয়ে বরং একটি রাজনৈতিক ফোরামে রূপ নিয়েছে। কখনো কখনো এই দুটি ফোরাম ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই একটা অনুগত বডি হিসেবে কাজ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন পরিপন্থী অনেক সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
একাডেমিক ক্ষেত্রে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিন, সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়োগ বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেধাই প্রধান মানদণ্ড হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায়, কিছু লোক হয়তো এই ধরনের ফোরামে পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণের পক্ষে মতপ্রকাশ করতে পারেন।
যদিও এ বিষয়ে কিছু যুক্তি রয়েছে, কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক মানের সঙ্গে কখনো আপস করতে পারে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞান সৃষ্টি এবং তার বিতরণের মাধ্যমে সমাজ রাষ্ট্রের পলিসি নির্ধারণে ভূমিকা পালন।
মেধা-নির্দেশিত গণতন্ত্র প্রয়োগ করাই বাস্তবসম্মত একটা প্রক্রিয়া হতে পারে, যার অর্থ হলো ডিন, সিনেট বা সিন্ডিকেটের মতো পদের জন্য প্রার্থীদের প্রথমে একাডেমিক এবং গবেষণার ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রাথমিক ক্যান্ডিডেসি অর্জন করতে হবে, তারপর সেই যাচাইকৃত যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে এবং শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও দলীয় প্যানেলভিত্তিক কাঠামো বন্ধ করে মেরিটোক্রেসি–ভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
অনুষদের ডিন নিয়োগপদ্ধতি দলীয়ভাবে/প্যানেলভিত্তিক না হয়ে বরং একাডেমিক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই হওয়া উচিত। সরাসরি দলীয় কাউকে ডিন মনোনয়ন দেওয়া বন্ধ করে বরং প্রার্থীদের একাডেমিক যোগ্যতা, একাডেমিক অভিজ্ঞতা, তার গবেষণার সাইটেশন সংখ্যা, পিএইচডি ডিগ্রির মান, রিসার্চ প্রোফাইল, জব এক্সপেরিয়েন্স এগুলো বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ তিন থেকে চারজনকে ইলেকশনের জন্য বাছাই করবেন। সেখান থেকে সাধারণ শিক্ষকরা ভোটের মাধ্যমে ডিন নির্বাচিত করবেন। এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ডিন স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে থেকে একাডেমিক এক্সিলেন্স এবং ফ্যাকাল্টির গবেষণা ও উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আশা করা যায়।
একই রকমভাবে এখন থেকে সিনেট এবং সিন্ডিকেটে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবশ্যই কিছু নীতিমালা সেট করা প্রয়োজন। অবশ্যই সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচন করবেন বা প্রার্থী হতে চান, তাঁদের একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন দেখতে হবে, বিশেষ করে তাঁদের অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্টসহ নিজ নিজ ফিল্ডে তার দক্ষতা এবং অবদান বিবেচনায় নিতে হবে।
শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচন করবেন অবশ্যই তাঁদের একাডেমিক যোগ্যতা, একাডেমিক অভিজ্ঞতা, গবেষণার সাইটেশন সংখ্যা, পিএইচডি ডিগ্রির মান—এগুলো বিবেচনায় নিয়ে যাচাই কমিটি একটি নির্দিষ্টসংখ্যক প্রার্থীকে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করবেন।
এ ছাড়া সিনেট ও সিন্ডিকেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব থাকার বিধি কার্যকর করতে হবে, কারণ এখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়ার বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০২৪–এর ১৭ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে সিন্ডিকেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকলে ডিসিশন মেকিংয়ে তাঁদের মতামত দেওয়ার গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কমাতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যে রকম নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে— যে কেউ এই পদে থেকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরোধী। আমরা মনে করি, বিভাগ এবং অনুষদে ভিসির অনেক কাজ ভাগ করে দিয়ে ক্ষমতা বা অথোরিটির চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করা দরকার। ভিসি সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করবেন, কিন্তু সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর একক ক্ষমতা প্রয়োগের বিধানের সংস্কার করা দরকার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। তবে এই স্বায়ত্তশাসন যেন শিক্ষকদের জবাবদিহিহীন না করে সে জন্য একটি স্বচ্ছ অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের ইভালুয়েশন পদ্ধতি চালু করে শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
ভার্সিটিতে ইউজিসি এবং মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। যেই সিনেট ক্ষমতাসীন দলের অনুগত শিক্ষকদের একটা ফোরামে পরিণত হয়েছে, সেই সিনেটের ভোটে এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনজন থেকে একজনকে নিয়োগদানের আড়ালে মূলত প্রধানমন্ত্রীই উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মূলে আঘাত করেন।
উপাচার্য নিয়োগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখাই হবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংস্কারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা মনে করি, ভিসি নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এবং সিনেট একটা উপাচার্য প্যানেল বা সার্চ কমিটি গঠন করতে পারে, যেখানে দেশের ভেতর থেকে আন্তর্জাতিক মানের পাঁচজন দক্ষ প্রফেসর এবং দেশের বাইরে থেকে তিনজন আন্তর্জাতিক প্রফেসর, একজন জাতীয় অধ্যাপক এবং একজন শিক্ষাবিদকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
এই সার্চ কমিটি প্রকাশ্য সার্কুলার দিয়ে তারপর উপাচার্যপ্রার্থীদের একাডেমিক উৎকর্ষ, রিসার্চ প্রোফাইল, ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণায় কী কী অবদান রাখবেন তার রূপকল্প তৈরি ও বাস্তবায়নের রূপরেখার স্কিল এসব শর্তকে বিবেচনায় নিয়ে একজন যোগ্য উপাচার্য নিয়োগ দেবেন।
আমাদের উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম এবং পাঠদানপদ্ধতিকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে এটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিমুখী আলোচনা ও মতবিনিময়কে উৎসাহিত করে, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শ ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হবে, তবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানকাঠামোর মতাদর্শিক আধিপত্য শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। অবশ্যই পাঠক্রম ‘স্বীকৃত সর্বজনীন মানবাধিকারের’ ও নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তবে এটি কোনো মতাদর্শিক পক্ষপাত (বাম বনাম ডান, উদারপন্থী বনাম রক্ষণশীল, জাতীয়তাবাদী বনাম বিশ্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মীয় ইত্যাদি) বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত হবে না।
নতুনভাবে প্রণীত এই শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্যই শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তাভাবনা ও আইডিয়া তৈরি করার সুযোগ দিতে হবে। শুধু পূর্ববর্তী পণ্ডিতদের লেখা অন্ধভাবে অনুসরণ না করে শিক্ষার্থীরা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা করবে এবং নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তৈরি করবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে মতাদর্শিক পক্ষপাত থেকে মুক্ত করতে হবে এবং তা বিভিন্ন তত্ত্ব ও ধারণার সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করার উপায় হিসেবে কাজ করবে।
পাঠক্রমটি এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে বাংলাদেশের স্নাতক শিক্ষার্থীরা কেবল বৈশ্বিকভাবে প্রচলিত হেজিমনিক ধারণার ভোক্তা না হয়ে তাঁদের বিশ্লেষক ও ব্যাখ্যাকারী হিসেবে গড়ে ওঠে। যদি শিক্ষার্থীরা তাঁদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়, তবে এটি আমাদের দেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিপ্লবী প্রভাব ফেলবে।
ড. যোবায়ের আল মাহমুদ সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. রাশেদ আলম ভূঁইয়া সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়