বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সেখানে কমপক্ষে ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর যে আস্থার ঘাটতি আছে, সেটি নির্বাচন কমিশন অকপটে স্বীকার করেছে। কমিশন আরও উল্লেখ করেছে যে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এ রকম একটি আস্থার সংকটে এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে নির্বাচন কমিশনের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত জাতিকে বিস্মিত করেছে।
অনেকে এই সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী এবং অযৌক্তিক মনে করেন। দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক ইভিএম ব্যবহারের এই সিদ্ধান্ত থেকে নির্বাচন কমিশনকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কমিশন ইভিএমের পক্ষে প্রধানত দুটি যুক্তি দেখিয়েছে। প্রথমত: ব্যালটে ভোট গ্রহণ হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে ও পরে ইচ্ছামতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব কিন্তু ইভিএমে সেটি সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত: ইভিএম নিয়ে সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দল ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু যারা ব্যালট ডাকাতি করতে পারে, তারা ইভিএম জালিয়াতি করতে পারবে না—কমিশনের এমন সরল চিন্তা অবান্তর।
আবার ২৯টি দলের মধ্যে ১৭টি ইভিএমের পক্ষে বলেছে বলে কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সহজ গাণিতিক হিসাবটিও অমূলক এবং একপেশে। বিষয়টি আসলে ভোটাভুটির নয়, মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অবশ্যই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তার প্রকৃত সুবিধা-অসুবিধা যাচাই-বাছাই করে নেওয়াটাই সমীচীন।
পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করে। এই দেশগুলোর প্রায় সবাই রাজনৈতিকভাবে সহনশীল, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। কিন্তু কমিশন যে সময় ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছে, সেটি মোটেও সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ নেই। নির্বাচনব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি স্পষ্ট। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিও মানুষের চরম অবিশ্বাস।
এ রকম একটি সময়ে ইভিএমের মতো একটি সংবেদনশীল এবং বিতর্কিত বিষয়ে কমিশনের অতি আগ্রহ জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। সার্বিকভাবে একটি সীমিত গণতান্ত্রিক পরিবেশে, একটি কর্তৃত্ববাদী দলীয় সরকারের অধীন, একটি রাজনৈতিক অসহনশীল এবং আস্থাহীনতার পরিবেশে ইভিএমের সিদ্ধান্ত যৌক্তিকভাবেই বিতর্কের সূচনা করেছে। এ ছাড়া দেশে যখন বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট, তখন কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে ইভিএম কেনাটা কতটা আবশ্যক এবং যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ইভিএম নির্বাচন পরিচালনার জন্য যতই নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ ও সুরক্ষিত দাবি করা হোক না কেন, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যারা বলছে ইভিএমে কারচুপি করার সুযোগ আছে, তাদের এই দাবি অমূলক নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায় দুই দশক থেকে ইভিএম যাত্রা শুরু করলেও এটি নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর কিংবা ২০২০ সালের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০২০ সালে উত্তর প্রদেশের পৌর নির্বাচনের সময় দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ভোটিং মেশিনে যে বাটনই টেপা হোক না কেন, শুধু বিজেপির জন্য ভোট রেকর্ড হয়। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বিজেপির নেতা ইভিএম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইভিএম দিয়ে যেকোনো কিছু করা যেতে পারে।’
২০১৭ সালে ভারতে ইভিএম টেম্পারিং নিয়ে বিতর্ক উঠলে এর অন্যতম নির্মাতা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভারত ইলেকট্রনিকসকে রাজনৈতিক দলগুলোকে ইভিএমের অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি পরীক্ষা করার অনুমতির কথা বললে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, এই সুযোগ দেওয়া হলে দলগুলো তাদের মতো ইভিএম ডিজাইন করবে, যাতে সব ভোট তাদের দিকে যায়। এই বক্তব্য প্রমাণ করে ইভিএমে টেম্পারিং করার সুযোগ আছে।
ইভিএমের একটি বড় দুর্বলতা হলো এটি নিরীক্ষণ যোগ্য নয়। যদি কোনো কারণে ভোট নিয়ে সংশয় তৈরি হয় ইভিএমে এটি পুনর্গণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। ফলে ইভিএমের নির্ভরতা ও নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে অধিকাংশ দেশে ইভিএমের সঙ্গে ভোটার ভেরিফিয়েবল পেপার অডিট ট্রেল (ভিভিপিএটি) ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি একটি নিরীক্ষাযোগ্য উপায়, যার মাধ্যমে ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারেন তাঁদের ব্যালট গণনার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ভিভিপিএটি বা ভিভিপাট ছাড়া নির্বাচনের ফলাফল স্বাধীনভাবে অডিট করার উপায় নেই। প্রার্থী ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন নাকি ইভিএমের ত্রুটি বা দূষিত সফটওয়্যার দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, সে বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে যায়।
ইভিএম ব্যবহারের আরেকটি ঝুঁকি হলো মেশিন নির্মাতা বা সরবরাহকারীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের যোগসাজশ। যখন দলীয় সরকারের অধীন একটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি বেসরকারি নির্মাতার ওপর নির্ভর করবে, তখন সরকারে থাকা বর্তমান রাজনৈতিক দলের ‘প্রয়োজন’ অনুসারে নির্মাতা মেশিন তৈরি করবে না, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বেসরকারি নির্মাতার ওপর নির্ভর করার আর একটি শঙ্কা হলো, ভোটিং সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ মুষ্টিমেয় করপোরেটের হাতে চলে যেতে পারে, যারা অর্থ ব্যয় করে ইভিএম ক্রয়সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষতা ও কার্যকারিতার বিচারে ইভিএম পেপার ব্যালট পদ্ধতির তুলনায় ভালো নয়। এমনকি বিভিন্ন ত্রুটির কারণে এটি আরও খারাপ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যায়, ইভিএমের নির্ভুলতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে যে অনুমান সেটি সব সময় ঠিক হয় না এবং ইভিএমে অনেক ধরনের ই-প্রতারণা পদ্ধতি রয়েছে, যা নির্বাচনের দিনে অপেক্ষাকৃত কম লোকের দ্বারা বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফলে ইভিএমে জালিয়াতি হলে সেটি হবে বৃহৎ পরিসরে, পাইকারি হারে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রায় ১০ শতাংশ ভোটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ ছিল।
ইভিএম ব্যবহারের আরেকটি ঝুঁকি হলো মেশিন নির্মাতা বা সরবরাহকারীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের যোগসাজশ। যখন দলীয় সরকারের অধীন একটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি বেসরকারি নির্মাতার ওপর নির্ভর করবে, তখন সরকারে থাকা বর্তমান রাজনৈতিক দলের ‘প্রয়োজন’ অনুসারে নির্মাতা মেশিন তৈরি করবে না, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনে যেখানে ১ শতাংশেরও কম ভোট ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়, সেখানে ১০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকা একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়া একটি জরিপে দেখা যায়, বয়স্ক ভোটার যাঁদের বয়স ৫৯ বছর এবং অধিক তাঁদের মাত্র ৩২ শতাংশ এটি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোয় ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে এখনো বেশির ভাগ শিল্পোন্নত দেশে একটি সহজ, সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ এবং পরীক্ষিত পদ্ধতি হিসেবে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা এখনো ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং সমাদৃত।
ইভিএমের কিছু সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর প্রতি মানুষের আস্থার ঘাটতি প্রকট এবং ঝুঁকি অনেক বেশি। যে দেশে প্রযুক্তিকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার চুরি হয়ে যায়, ব্যাংকিং চ্যানেলের ফাঁক গলিয়ে বিদেশে টাকা পাচার হয়, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি হয়, সে দেশে মেশিনের ওপর মানুষের আস্থা অর্জন অনেক বড় চ্যালেঞ্জে। তবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সফল নির্বাচনের জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো নির্বাচন কমিশনের প্রতি ‘আস্থা’ অর্জন। দার্শনিকদের মতে, মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য আপনি কী বলেন তা নয়, আপনি কী করছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ইভিএম ঘিরে যে অবিশ্বাস এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে কমিশনের ইভিএম–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
ই–মেইল: faridecoru@yahoo.co.uk