বেস্টসেলার হওয়ার সহজ উপায় আমি আপনাদের শিখিয়ে দিচ্ছি। সামনে বইমেলা, আপনার বই বের হচ্ছে। কিন্তু কেউই আপনার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করছে না। এতে আপনার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, ক্ষতি হচ্ছে বাংলার পাঠককুলের, তারা আপনার মতো একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের লেখার পরশমণিতুল্য স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিকে এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে। বসে থাকবেন না, ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
কী করে সহজ উপায়ে বেস্টসেলার লেখক হবেন।
১. রিসাইকেল পদ্ধতি: আপনাকে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। আপনি বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে বই কিনবেন। জি, নিজের বই কিনবেন। দশটি ঠিকানার প্রত্যেকটা থেকে এক হাজার টাকা করে বই কিনবেন। যদি আপনার বইয়ের দাম ২৫০ টাকা হয়, আপনি প্রথম সপ্তাহে ৪০টি বই কিনতে পারবেন।
এরপর আপনি পরের সপ্তাহে আবার ৪০টি বইয়ের অর্ডার দেবেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আপনার প্রকাশকের কাছে আসবে বই নিতে। আপনার কেনা বইগুলোই বিক্রির জন্য অনলাইনওয়ালাদের দিয়ে দেবেন।
আপনি কম দামে বেচবেন, বেশি দামে কিনবেন, ফলে প্রতিবার আপনার আড়াই হাজার টাকা ক্ষতি হবে। হোক।
আপনি আবার ৪০ কপি বই অর্ডার করবেন। এইভাবে প্রতি সপ্তাহে বই কিনতে কিনতে আপনার ২০ হাজার টাকা একটা সময় ফুরিয়ে আসবে। তত দিনে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো আপনাকে বেস্টসেলার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেবে। তখন পাবলিকই আপনার বই কিনতে থাকবে।
আপনি যদি ৫০ হাজার টাকা রিসাইকেল করতে পারেন, এক বছর আপনি অনলাইনের এক নম্বর লেখক হিসেবে থাকতে পারবেন।
২. ডেভিড কপারফিল্ড পদ্ধতি: আপনারা কি এই জাদুটা দেখেছেন? ডেভিড কপারফিল্ড একটা আস্ত ট্রেনকে অদৃশ্য করে ফেলছেন। শত শত দর্শক দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। একটা ট্রেন এল। কপারফিল্ড কাপড় দিয়ে ট্রেনটাকে ঢাকলেন। ছু মন্তর ছু। ট্রেনটা আর নেই।
জাদু কোনো কৌশল অবলম্বন করে করা হয়, অনলাইনেই সেই রহস্য উন্মোচন করার ভিডিও আছে। এবার সেটা দেখে নিন। ট্রেন কীভাবে অদৃশ্য করা হয়।
ট্রেনটা আসে। সেটা ঢাকা হয়। সেটার ভিডিও শুট করা হয়। তারপর ট্রেনটাকে সরিয়ে ফেলা হয়। তখন ক্যামেরা বন্ধ থাকে। ট্রেনটা সরিয়ে দিয়ে তারপর আবার ভিডিও করা হয়।
তাহলে উপস্থিত দর্শকেরা আপত্তি না করে হাততালি দেয় কেন? কারণ দর্শকেরা সবাই জাদুকরের কর্মচারী। এই দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য তাদের বেতন দেওয়া হয়।
আপনি ৩০ জন বিভিন্ন বয়সের লোক নিয়োগ দেবেন। তারা বইমেলায় আপনার স্টলের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আপনি বইমেলায় গেলে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনে অটোগ্রাফ নেবে। ভিড় দেখে আরও কিছু সত্যিকারের ক্রেতাও লাইনে দাঁড়াবে।
আপনি প্রতি সপ্তাহে একবার করে মেলায় যাবেন। একবার করে লোকেরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই লোকগুলোকে আপনার বেতন দিতে হবে। এই সব দৃশ্য আবার ভিডিও করবেন। অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করবেন।
তবে লেগে থাকতে হবে। একবার করবেন, তারপর ছেড়ে দেবেন, তা হবে না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ম্যাজিক আপনাকে করে যেতে হবে। একসময় আপনি সাফল্য পাবেন।
আপনি ভাবছেন, এই সব হয় না? নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারের তালিকাতেই একাধিকবার প্রতারণার ঘটনা ঘটেছিল। একজন লেখক মাত্র ছয় বছর আগেই তাঁর বই একবারে কিনে নিয়ে গিয়ে তালিকায় নিজের নাম তুলতে পেরেছিলেন।
এখন নিউইয়র্ক টাইমস চার হাজার স্টোর থেকে বিক্রয়তালিকা সংগ্রহ করে থাকে। এখন প্রতারণা করা বেশ কঠিন। তবে অ্যামাজনে প্রতারণা করে বেস্ট সেলার তালিকায় ওঠা সম্ভব। শুধু টাকা খরচ করতে হবে।
রসিকতা বাদ দিই। বেস্টসেলার হওয়ার জন্য লিখবেন না। বঙ্কিমচন্দ্র বলে গেছেন: টাকার জন্য লিখিবে না। যশের জন্য লিখতেও তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, লিখে যদি সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারা যায় বা মানুষের উপকার করতে পারা যায়, তাহলে লেখালেখি করা যেতে পারে।
আর নীরদ সি চৌধুরী বলেছেন, লেখক দুই প্রকার। ছাগল লেখক আর পাগল লেখক। ছাগল লেখক লেখে টাকার জন্য, পাগল লেখক লেখে নামের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরস্কার’ কবিতায় কবি কেন লেখেন, তা বলে গেছেন:
সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মতো রবে।
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে,
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে—
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
মাগিছে তেমনি সুর।
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।
কয়েকটা কাঁটা যদি দূর করতে পারেন, তাহলে তো লিখতেই হবে।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক