মতামত

ভূরাজনীতি: আমেরিকা প্রশ্নে যে পথে হাঁটছে ভারত

২০২২ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত জি–২০ সম্মেলনে বাইডেন ও মোদি
ছবি : রয়টার্স

গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এতটা দ্রুততায় গভীর ও জোরালো হয়েছে, যা আগে কখনোই হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অষ্টমবারের মতো এবং জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে যাচ্ছেন।

দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় ঘনিষ্ঠতায় ভারতের যেমন লাভ আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের এতে ন্যূনতম স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ আছে।

জনসংখ্যার দিক থেকে মাত্রই চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া ভারতের অর্থনীতি এখনো যদিও তুলনামূলকভাবে ছোট, তবে তার আকারও অধিকতর দ্রুততায় বাড়ছে। এখন ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে ভারত ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে গেছে এবং জার্মানিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ও পণ্য রপ্তানির বৃহৎ বাজার হয়ে উঠছে ভারত।

তবে এটি দুই দেশের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার শুরু মাত্র। ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই যুগে চীনের (এবং চীনের ক্রমবর্ধমানভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা রাশিয়ার) ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তিকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদারদের সহযোগিতা কামনা করছে।

ভারত পশ্চিমে তার সহযোগী গণতন্ত্রগুলোর জন্য একটি সুস্পষ্ট অংশীদার, যদিও ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ প্রকৃতি নির্ধারণে এবং অবশ্যই আরও ব্যাপক অর্থে বললে বলা যায়, বিশ্বব্যবস্থা নির্ধারণে ভারত একটি ‘দোদুল্যমান রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছে। রাশিয়া-চীনের উদীয়মান জোটের দিকে ভারতের ঝুঁকে যাওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

ভারত বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থকে বিঘ্নিত করছে না। যে পাকিস্তানে গণগ্রেপ্তার, গুম ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা, সেই পাকিস্তানকে আঁকড়ে ধরে রেখে মিয়ানমার ও ইরানের ওপর অবরোধ জারি রাখার মার্কিন নীতিও ভারতকে অস্বস্তিতে রেখেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ইসলামপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র এই বলে হুমকি দিয়েছে যে দেশটির আসন্ন নির্বাচনে সরকার কোনো অনিয়ম করলে সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

তথাকথিত বন্ধুত্ব গড়ার মাধ্যমে সরবরাহ শৃঙ্খলে স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোয় আমেরিকার বর্তমান আগ্রহের কথা বিবেচনা করুন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি ‘আস্থাশীল বাণিজ্যিক অংশীদার’ যাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘অর্থনৈতিক একীকরণকে সক্রিয়ভাবে গভীরতর করছে’, কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে এমন দেশগুলো থেকে বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতকে যুক্ত রাখাটাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনস্বীকার্য। ভারতের সঙ্গে চীনের সামরিক দ্বন্দ্ব ৩৮তম মাসে গড়িয়েছে। ভারত পিছু তো হটেইনি, উল্টো চীনের সম্প্রসারণবাদের প্রতি খোলামেলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, যা চীনের জন্য তাইওয়ানে হামলা করা অনেক কঠিন করে তুলেছে।

বাইডেন চীন ও ভারতের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে কখনো কথা বলেননি বটে, তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। চলতি মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের দিল্লি সফর অন্তত সে কথাই বলছে।

ইতিমধ্যেই ভারত বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশিসংখ্যক সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে যে চারটি ‘ভিত্তিসূচক’ চুক্তি মেইনটেইন করে তার সবগুলোতেই ভারত ২০২০ সালের মধ্যে সই করেছে।
এর মানে হলো, এই দুই দেশ অন্য বিষয়ের পাশাপাশি সামরিক স্থাপনা এবং বিমান ও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পরস্পর বিনিময় করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারত ইতিমধ্যে কোয়াড-এ যোগ দিয়েছে, যা গ্রুপটিকে তার প্রয়োজনীয় শক্তি জুগিয়েছে।

ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিদলীয় ঐকমত্য অর্জন একটি বিরল ঘটনা। সেই ঘটনাই মোদি ঘটিয়েছেন। মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার জন্য মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেবেন। এর আগে রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে ভাষণ দিয়েছিলেন। এবার ডেমোক্র্যাট নেতা বাইডেনের আমন্ত্রণে ভাষণ দেবেন। এর মধ্য দিয়ে মোদিই হবেন প্রথম ভারতীয় কোনো নেতা, যিনি ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় দলের পক্ষ থেকে মার্কিন কংগ্রেসে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন।

এরপরও পশ্চিমের অনেক সংশয়বাদী বিশ্বাস করেন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত গাঁটছড়া বাধা শেষ পর্যন্ত হতাশাই বয়ে আনবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি একজন বিশ্লেষক বলেছেন, ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত মিত্র হতে পারবে না। আরেকজন ভাষ্যকারের বিশ্লেষণ হলো, চীনের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব গড়ে তেমন কোনো ফায়দা হবে না।

তাদের উদ্বেগের মূল বিষয় হলো ভারত তার কৌশলগত স্বাধীনতা ধরে রাখার বিষয়ে অবিচল রয়েছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত খুব কমই জোট নিরপেক্ষতার কথা বলেছে এবং বাস্তবে ভারত বহু জোটে যুক্ত হয়েছে। ভারত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে তার অংশীদারিকে গভীর করার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে তার ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পরস্পর বিপরীতমুখী বলে মনে হচ্ছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বিস্তৃত এবং বহুমুখী অংশীদারি গড়ে তুলছে। মনুষ্যচালিত মহাকাশযান উৎক্ষেপণে সহযোগিতা থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল পর্যন্ত সবকিছুই তাতে আছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন প্রায় একচেটিয়াভাবে প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানির মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে বলে মনে হচ্ছে।

তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম যেভাবে রাশিয়াকে পরিত্যাগ করেছে, সেভাবে রাশিয়াকে ভারতের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ভারত এখনো রাশিয়াকে চীনের চাপ মোকাবিলায় একটি সহযোগী শক্তি মনে করে।

ভারত মনে করে, চীন ও রাশিয়া অভিন্ন স্বার্থে আটকে থাকা ‘প্রাকৃতিক মিত্র’ নয়, বরং তাদের মধ্যে ‘প্রাকৃতিক’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণেই এখন এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

আমেরিকার নীতির কারণে চীন ও রাশিয়ার যে অক্ষ তৈরি হয়েছে, তা না ভারতের স্বার্থে কাজ করে, না আমেরিকার স্বার্থে কাজ করে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি পুনর্বিবেচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে ভারতের মধ্যে হতাশা রয়েছে।

ভারত বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থকে বিঘ্নিত করছে না। যে পাকিস্তানে গণগ্রেপ্তার, গুম ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা, সেই পাকিস্তানকে আঁকড়ে ধরে রেখে মিয়ানমার ও ইরানের ওপর অবরোধ জারি রাখার মার্কিন নীতিও ভারতকে অস্বস্তিতে রেখেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ইসলামপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র এই বলে হুমকি দিয়েছে যে দেশটির আসন্ন নির্বাচনে সরকার কোনো অনিয়ম করলে সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কৌশলগত স্বার্থের কারণেই পরস্পর এক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যত দিন চীন তার বর্তমান নীতির পথে হাঁটবে, তত দিন ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কও থাকবে।  

  • ইংরেজি থেকে অনূদিত স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
    ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বোচ একাডেমির একজন ফেলো