যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি তাঁর দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগকে ৮১৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার এক বিলে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনের মর্যাদা দিলেন। এনডিএএ নামে পরিচিত এই আইন মুখ্যত তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এর বৈশ্বিক তাৎপর্য অনেক। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাব হবে সরাসরি। কারণ, এবারের এই বরাদ্দপত্রে সংযুক্ত হয়েছে মিয়ানমারকেন্দ্রিক ‘বার্মা অ্যাক্ট’।
চলতি ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বিল পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চার্চগুলো এই বিল পাসের জন্য লাগাতার তদবির করে যাচ্ছিল। এই বিল এবং বাইডেন প্রশাসনের ২০২৩ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে তার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের মনোযোগ দাবি করে। বাইডেন প্রশাসনের এ রকম পদক্ষেপে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা’র ধারায় অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। যে পরিবর্তন কেবল মিয়ানমারে নয়, আশপাশের দেশগুলোয় ইউএসএইডের তৎপরতায়ও দেখা যেতে পারে।
একালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্টের কথা শুনে অনেকের মনে পড়তে পারে কার্ল মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি করে। প্রথমে সেটা ঘটতে পারে ট্র্যাজেডি আকারে, পরে সেটা ঘটে প্রহসনরূপে।’ ৮৭ বছর আগে ১৯৩৫ সালে এ অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা আরেকটি ‘বার্মা অ্যাক্ট’ করেছিল, ভারত থেকে ওই অঞ্চলকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে। ১৯৩৭ সালে সেই আইন কার্যকর হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বলতে ব্যাপক সামরিক জবাবদিহির অধীনে এনে ‘মিয়ানমারকে ঐক্যবদ্ধ’ করতে চায় বাইডেন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের প্রবাসী নাগরিকের সংখ্যা দুই লাখও নয়। তারপরও বেশ দ্রুতলয়ে এই বিল অনুমোদনের পথে এগিয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এই বিল নিয়ে কাজ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ। এ বছর সিনেটে পাসের বেশ আগে এই বিল আইনসভার নিম্নকক্ষেও পাস হয়। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বেশ ঐকমত্যও দেখা গেছে এই বিল নিয়ে।
ইতিহাসের এই দ্বিতীয় ‘বার্মা অ্যাক্ট’ অনুমোদন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটে তার সংযুক্তির মূল রাজনৈতিক ফল কী হবে, সেটা অনেককে ভাবাচ্ছে এখন। নিশ্চিতভাবে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরও সরাসরি যুক্ত হয়ে গেল। যদিও এ যুক্ততা ঘটবে তাদের ভাষায় ‘মানবিক সহায়তা’র মাধ্যমে। কিন্তু এ-ও প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে এবং বিলেও আছে, মিয়ানমারের ভেতরকার গণতন্ত্রের সংগ্রামকে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেবে।
নামে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ হলেও এই আইন যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এই আইনের মনোযোগ এমন এক এলাকায়, যেখানে কেবল ভারত নয়, চীনেরও ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক স্বার্থ রয়েছে। ফলে ভারতের পাশাপাশি চীনেরও বার্মা অ্যাক্টের ফলাফল নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। মিয়ানমারের জান্তার বড় এক অভিভাবক বেইজিংয়ের নেতৃত্ব। ফলে নতুন পরিস্থিতির আঁচ লাগবে সরাসরি তাদের গায়েও।
দেশটিতে ‘বেসামরিক সরকার’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে মদদ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এবং জান্তাবিরোধী এনইউজি সরকারের কথাও সেখানে আছে। দেশটির বর্তমান সামরিক সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ‘বেআইনি’ কর্তৃপক্ষ মনে করছে এবং তাদের যারা তহবিল দেবে—এমন শক্তির বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র শক্ত ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে বলেও ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বলছে। জান্তার শক্তি কমাতে মিয়ানমারের জ্বালানি খাতও এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় লক্ষ্যবস্তু হবে বলে উল্লেখ রয়েছে এতে। খনিজ জ্বালানি এই মুহূর্তে স্থানীয় সেনা-তহবিলের বড় উৎস।
বার্মা অ্যাক্ট অনুমোদনের পাশাপাশি এনডিএএ নামে পরিচিত বাইডেন প্রশাসনের ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্ট অনুমোদন একসঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র কত ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব প্রস্তুতি দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজকেন্দ্রিক সম্পৃক্ততাও বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রে এনডিএএর অংশ হিসেবে বার্মা অ্যাক্ট অনুমোদনের খবর মিয়ানমারে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এতে দারুণ উজ্জীবিত। অন্যদিকে জান্তা এই খবরে তার দমন-পীড়ন আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা এখন ২০০৮ সালের বিতর্কিত সংবিধানের আলোকে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে এক দফা জাতীয় নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে।
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়াতে সামরিক শাসনকে একটা বেসামরিক প্রচ্ছদ দিতে চাইছে। সে লক্ষ্যে তারা নিজেদের সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি পার্টিকে প্রস্তুত করছে। আবার সু চির এনএলডি থেকেও কিছু সংগঠককে নিজেদের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে বার্মা অ্যাক্টের পর গণতন্ত্রপন্থী গেরিলা এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সশস্ত্র দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাড়তি সহায়তা আশা করছে, যা অস্ত্রপাতি না হলেও ‘কারিগরি সহায়তা’ আকারে সশস্ত্র লড়াইয়ের নিরস্ত্র জ্বালানি হিসেবে তাদের কাজকে আরও গতি দেবে। এই দুই ধারার গেরিলাদের হাতে দেশটির প্রায় অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইতিমধ্যে। এত দিন এ রকম কোনো কোনো সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকলেও ভবিষ্যতে সেটা হয়তো পাল্টাবে।
যদিও বার্মা অ্যাক্টের প্রস্তাবক হলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির আফ্রিকান-আমেরিকান জনপ্রতিনিধি গ্রেগরি মিকস্, কিন্তু এই বিল পাসে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত চার্চ নিরলস ভূমিকা রেখেছে। এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
মিয়ানমারের ভেতর যে তিনটি অঞ্চলে এই মুহূর্তে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা বেশি, সেগুলো হলো কাচিন, চিন ও কারেন এলাকা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর স্থল ও বিমান আক্রমণে এসব এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি আহত ও নিহত হচ্ছেন। জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধও এসব অঞ্চলেই বেশি। অং সান সু চির দলের নেতারা জাতিতে বামার এবং ধর্মে বৌদ্ধ হয়েও এসব এলাকায়ই আশ্রয় পেয়েছেন বেশি।
কারেন, কাচিন ও চিনদের এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী রয়েছে। চিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক খ্রিষ্টান। কাচিন ও কারেনদের মধ্যেও খ্রিষ্টান অনেক। অন্যদিকে চিনের পাশের ভারতীয় অঞ্চল মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মণিপুরও খ্রিষ্টানপ্রধান এলাকা।
আবার ভারত-মিয়ানমার ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্তের দুই দিকের মানুষই মূলত একটা পরিবারের মতো। কাচিনের নাগা আর মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের নাগা একই সংস্কৃতির মানুষ। যেভাবে মিজোরামের কুকি-মিজো-জোমিরা মিয়ানমারের চিন স্টেটের ট্রাইবগুলোর আত্মীয়মাত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, আত্মীয়তা সব মিলে স্মরণাতীত কাল থেকে এসব মানুষ পরস্পরকে চেনে-জানে।
১৯৩৫ সালে ভারত থেকে মিয়ানমারকে আলাদা ‘রাষ্ট্র’ করেছিল ব্রিটিশ শক্তি। আর ১৯৫৩ সালে নেহরু-নে উইন একটা সীমান্ত কল্পনা করে নিয়েছিলেন সেখানে। এভাবে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত জাতিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ঔপনিবেশিক কালের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে সুখী নয়। ব্রিটিশ শাসনের আগে তারা কেউ দিল্লি বা রেঙ্গুনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তাদের ঐতিহাসিক অসুখী মনোভাবেরই ছাপ দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী সংগ্রামে কাচিন, চিন ও কারেনদের লড়াইয়ে এবং তার প্রতি মিজো ও নাগাদের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থনে।
বার্মা অ্যাক্ট প্রকাশ্যে আসার প্রক্রিয়া স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, কারেন-কাচিন-চিনদের নির্বিচার আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা থামাতে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে হস্তক্ষেপ করবে ভবিষ্যতে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টা তাৎপর্যবহ। কারণ, এসব অঞ্চল মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বাংলাদেশের নিকটবর্তী। নাগা নেতা ফিজো যেমন একসময় কাচিনে থাকতেন, মিজো নেতা লালডেঙ্গাও একসময় চট্টগ্রামে থাকতেন। আজকের ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ যেন পুরোনো এসব ইতিহাসকেই ফিরে ফিরে দেখাচ্ছে এবং ভাবাচ্ছে। সীমান্তপ্রাচীর তুলে সীমান্তের দুই দিকের ইতিহাসকে মুছে ফেলা কঠিন, যা বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ১৯৮৯ সালে জার্মানরা একবার দেখিয়েছিল।
নামে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ হলেও এই আইন যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এই আইনের মনোযোগ এমন এক এলাকায়, যেখানে কেবল ভারত নয়, চীনেরও ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক স্বার্থ রয়েছে। ফলে ভারতের পাশাপাশি চীনেরও বার্মা অ্যাক্টের ফলাফল নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। মিয়ানমারের জান্তার বড় এক অভিভাবক বেইজিংয়ের নেতৃত্ব। ফলে নতুন পরিস্থিতির আঁচ লাগবে সরাসরি তাদের গায়েও।
তবে বাংলাদেশের জন্যও এই আইন–পরবর্তী ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার জায়গা তৈরি করছে। মিয়ানমার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ার এদিকে কূটনীতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা ছড়াতে পারে। এ রকম উত্তেজনা সব সময় যে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে নিথর হয়ে থাকে, তা নয়।
আলতাফ পারভেজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাস বিষয়ে গবেষক