তেহরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বিক্ষোভকারীরা
তেহরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বিক্ষোভকারীরা

ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য যুদ্ধ কী বার্তা দিচ্ছে

অনেকের মতে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী সরকার ধীরে ধীরে, ইচ্ছাকৃতভাবে, ইরানের পক্ষের সামরিক শক্তিকে পাল্টা আঘাত করার জন্য গাজা যুদ্ধকে সম্প্রসারিত করেছে।

কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল এবং ইরান ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। একে অপরের ওপর আক্রমণ করেছে পরোক্ষভাবে প্রক্সি বাহিনী, গুপ্তহত্যা, তাদের গোপন তথ্যদাতা, গুপ্তচর এবং বেসামরিক গোপন উপায় ব্যবহার করে। এখন এই অঘোষিত নীরব যুদ্ধ স্পষ্টতই প্রকাশ্যে এসে গেছে। এই যুদ্ধ এখন সরাসরি গোলাগুলি চালানোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধ ক্রমেই বাড়ছে। কোথায় যে এর শেষ, তা বোঝা যাচ্ছে না।

শনিবার ভোরে তেহরানের ওপর ইসরায়েলের বড় আকারের বিমান হামলা হয়েছে। এর মানে, দুই শত্রু এখন সরাসরি সংঘর্ষে নেমে পড়েছে। এখনো তা পুরো মাত্রায় ছড়ায়নি। আঞ্চলিক এই সংঘর্ষ ক্রমে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, এমন আতঙ্ক এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই আছে। তা হতেও পারে। তবে তা এখনো ভবিষ্যতের গর্ভেই লুকিয়ে আছে।

এই মাসের শুরুতে ইরানের মিসাইল আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে নেমে পড়েছে। এর অর্থ এই যে আরেকটি মানসিক বাধা পার হয়ে গেছে ইসরায়েল। ইরানের মিত্র হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি নাগরিকদের আক্রমণ করে হত্যার আগে এই দুই দেশ যে একে অপরের মাটিতে মুখোমুখি সামরিক সংঘর্ষ পরিচালনা করবে, তা কল্পনা করা কঠিন ছিল। তখন পর্যন্ত তা মনে করা হতো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর আজ তা যেন স্বাভাবিক এক ব্যাপার মনে হচ্ছে।  

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হলো। এর পর থেকে ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে সমর্থন করে আসছে। ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ইরান সেই লক্ষ্যে তৈরি করেছে নিজেদের এক অক্ষ। ইসরায়েলিরা একে বলে ‘আগুনের বলয়’। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী এবং পাশাপাশি হামাসের মতো সুন্নি ইসলামপন্থীদের নিয়ে একটি ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তৈরি করেছে তারা।  

২০২৩–এর ৭ অক্টোবরের পর থেকে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী সরকার ধীরে ধীরে গাজা যুদ্ধকে প্রসারিত করেছে। উদ্দেশ্য, এই গোষ্ঠিগুলোসহ ইরানকে পাল্টা আঘাত করা। নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহর লাগাতার রকেট হামলা এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে আসছেন।

গাজা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি চুক্তির ওপর আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য ব্লিঙ্কেনের সর্বশেষ চেষ্টা কোনো ফল বয়ে আনেনি। বোঝাই যাচ্ছে, এই সব সহিংসতা এবং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার মূল কারণগুলো আসলে লক্ষই করা হয়নি। ইসরায়েল ও ইরান এক হাত পেছনে লুকিয়ে রেখে পাল্টাপাল্টি আঘাত চালিয়ে যাবে হয়তো। আর গাজায় ভয়ংকর মানবিক ট্র্যাজেডি ক্রমে আরও খারাপ অবস্থায় যাবে। কিন্তু লড়াইয়ের ডামাডোলে সেই সব মৃত্যু চলে যাবে শিরোনামের বাইরে।

কিছু তো হওয়ার কথাই ছিল। আর এ বছরের ১ এপ্রিল তা হলো। দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক কনস্যুলেটে ইসরাইলি বোমা হামলায় দুই জ্যেষ্ঠ জেনারেল নিহত হলেন। এই জেনারেলরা হামলার জন্য পরিকল্পনা করছিলেন বলে ইসরায়েল দাবি করে। ক্ষুব্ধ ইরান ১৩ এপ্রিল পাল্টা আঘাত করে। ইসরায়েলি ভূখণ্ডে এই ছিল তার প্রথম সরাসরি সামরিক হামলা। এত দিনের দ্বিধা ভেঙে গেল।

ইসরায়েল পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। তবে কোনো পক্ষই খুব বেশি ক্ষতি করেনি। আর তা সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই। তারপর এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। জুলাই মাসে তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ এবং গত মাসে বৈরুতে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড আবার পাশা পাল্টে দিল।

কট্টর পশ্চিমাবিরোধী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ছিলেন নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত বন্ধু। নাসরুল্লাহর মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। খামেনি ঘোষণা করলেন যে ইরানের রাজধানীতে অতিথি থাকাকালে হানিয়াহকে হত্যা করা হয়েছে, এই অপমান সহ্য করা হবে না। তাই ১ অক্টোবর ইরান তার দ্বিতীয়, বড় মাপের সরাসরি আক্রমণ শুরু করে।

তিন সপ্তাহ ধরে মধ্যপ্রাচ্য আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে যে ইসরায়েল পাল্টা কী করে। শেষ পর্যন্ত শনিবার এই হামলার জবাব দিয়েছে ইসরায়েল। এ নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মতানৈক্য ছিল। ইসরায়েলিদের কেউ কেউ বলছিলেন যে ইসরায়েলের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইরানের পারমাণবিক ও শক্তিকেন্দ্রগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালানো। এমনকি কেউ বলছিলেন যে খামেনি এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের নির্মূল করার চেষ্টা করার এটাই ভালো সময়।

ইসরাইয়েল কিন্তু সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত করার মধ্যেই নিজেদের  সীমাবদ্ধ রেখেছিল। বেসামরিক হতাহতের ঘটনা এড়াতে দৃশ্যত সতর্কও ছিল তারা। একে অনেকে আমেরিকান কূটনীতির সাফল্য হিসেবে দেখছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যক্তিগতভাবে নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়েছিলেন, যাতে এই সংঘাতের গতিকে বেশি বাড়তে দেওয়া না হয়। তিনি তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেট, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে গত সপ্তাহে সেই উদ্দেশ্যে জেরুজালেমে পাঠিয়েছিলেন।  

এইবার বাইডেনের কথা দাম দেওয়া হলো বলে মনে হয়। ৭ অক্টোবরের পর নেতানিয়াহুর আমেরিকান পরামর্শ গ্রহণ করার এ এক বিরল উদাহরণ। তবে তেহরান আবার আক্রমণ করলে ইসরায়েলের এই নেতা পারমাণবিক স্থাপনা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করবেন না, এই নিশ্চয়তা কে দেবে? ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের আক্রমণ প্রতিহত করতে তারা কতটা সক্ষম, তা–ও নিশ্চিত নয়।

সব কিছু এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, তা বুঝতে পেরে পেন্টাগন থেকে ইরানের কাছে সপ্তাহান্তে যে বার্তাটি গেছে তার অর্থ একেবারেই স্পষ্ট—পাল্টা আঘাত করার কথা ভেবো না। একই বার্তা সামোয়াতে কমনওয়েলথ সম্মেলনের বক্তৃতায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টার্মারের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে।

স্টারমার বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে ইসরায়েলের ইরানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। আমি এ–ও নিশ্চিত যে আরও আঞ্চলিক উত্তেজনা আমাদের এড়াতে হবে এবং সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে আমরা মিত্রদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।’

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন যে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস সংকট নিয়ন্ত্রণে ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। মার্কিন প্রশাসন প্রবলভাবে সব কিছু শান্ত রাখতে চায়। একই কারণে, পেন্টাগন জোর দিয়ে বলেছে যে সর্বশেষ ইসরায়েলি হামলায় মার্কিন বাহিনী জড়িত ছিল না।

প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে কী বোঝা যাচ্ছে? ইরান কী এই বার্তা গ্রহণ করবে? তারা কি সংঘাত আপাতত এড়িয়ে যাবে? তবে তাদের ওখানেও বিভিন্ন রকম মতের নীতিনির্ধারক রয়েছেন। তাঁদের অনেকে নিশ্চয়ই কঠোর পদক্ষেপের জন্য চাপ দেবেন।

গাজা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি চুক্তির ওপর আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য ব্লিঙ্কেনের সর্বশেষ চেষ্টা কোনো ফল বয়ে আনেনি। বোঝাই যাচ্ছে, এই সব সহিংসতা এবং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার মূল কারণগুলো আসলে লক্ষই করা হয়নি। ইসরায়েল ও ইরান এক হাত পেছনে লুকিয়ে রেখে পাল্টাপাল্টি আঘাত চালিয়ে যাবে হয়তো। আর গাজায় ভয়ংকর মানবিক ট্র্যাজেডি ক্রমে আরও খারাপ অবস্থায় যাবে। কিন্তু লড়াইয়ের ডামাডোলে সেই সব মৃত্যু চলে যাবে শিরোনামের বাইরে।

যতক্ষণ না গাজা এবং বৃহত্তর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হচ্ছে, যেকোনো সময় আরও বড় কোনো যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে। আর তার ধাক্কা সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।

  • সাইমন টিসডাল, অবজার্ভারের বিদেশবিষয়ক বিশ্লেষক
    গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন