বিশেষ সাক্ষাৎকার: লার্জ টেলার্ট

স্বাধীন সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না

লার্জ টেলার্ট। সাসটেইনেবল জার্নালিজম পার্টনারশিপের গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সভাপতি। তিনি সুইডেনের লিননাস ইউনিভার্সিটির ফোজো ইনস্টিটিউটের নীতি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের প্রধান। সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকতা শিক্ষণে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতালাভকারী এই সংবাদমাধ্যম–বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আয়েশা কবির সোহরাব হাসান

লার্জ টেলার্ট
প্রশ্ন

আপনি সাসটেইনেবল বা টেকসই সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করেন। টেকসই সাংবাদিকতা আসলে কী?

লার্জ টেলার্ট: আমি মনে করি, গতানুগতিকভাবে যা চলছে, সেটাই শেষ কথা নয়। বিশ্ব বদলাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নয়ন আমাদের জীবনের সবকিছু গ্রাস করে ফেলছে। আরেকটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তৃতীয় পরিবর্তন হলো জনগণ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে সংবাদের প্রতি অনাগ্রহ। আমরা দেখেছি, বিশ্বব্যাপী ২৫ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারা পত্রিকা বা খবর পড়ে না। তারা টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা অন্য কিছু দেখে। আমরা যেভাবে ও যে বিষয়ে খবর পরিবেশন করি, তার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। সাংবাদিকেরা রাজনীতি, নির্বাচন ইত্যাদির খবর দিতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু তরুণেরা এসব এড়িয়ে চলে। ফলে আমাদের সাংবাদিকতা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। টেকসই সাংবাদিকতা কেবল মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়া নয়। সাংবাদিকদের সেসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যা টেকসই সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবে। আমাদের অবশ্যই নতুন ব্যবসা মডেল তৈরি করতে হবে, যাতে আয় বৃদ্ধি পায়। আর্থিক স্বাধীনতা ছাড়া আমরা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা লাভ করতে পারব না। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতা সমস্যায় আছে। ফলে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে গণমাধ্যম নিজে টেকসই হবে, কীভাবে আমরা ডিজিটাল মাধ্যমে ভালো ব্যবসা মডেল তৈরি করতে পারব। কীভাবে সাংবাদিকতা কেবল গণতন্ত্র নয়, টেকসই সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবে। এটাই টেকসই সাংবাদিকতার ভিত্তি।

প্রশ্ন

কীভাবে গণমাধ্যমের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট করা যাবে?

লার্জ টেলার্ট: এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমরা সাসটেইনেবল জার্নালিজম পার্টনারশিপ নামে বিশ্বব্যাপী একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছি। এই নেটওয়ার্কে অভাবিত সাড়া পেয়েছি। ৬৭টি দেশ থেকে ২৫০ জন সদস্য হয়েছেন। ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড, ওয়ান-ইফরার মতো সংগঠন আমাদের সঙ্গে আছে। বহু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় এর সদস্য। গণমাধ্যমের অংশীজনেরাই আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেবে। আমাদের কাছে তৈরি উত্তর নেই। তবে আমাদের উত্তর খুঁজতে হবে কীভাবে তরুণদের গণমাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়। আমরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দুটি উপসংহার হলো আমরা যখন তরুণ শ্রোতা-পাঠকের কথা বলি, তাদের ফরম্যাটের কথাও চিন্তা করতে হবে। আমরা আর গণমাধ্যমের রক্ষাকর্তা নই। ৫০ বছর আগেই তা হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে তথ্যের বিশাল ভান্ডার, তার সঙ্গে আমাদের বাছাই করতে হবে কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক তথ্য। তথ্যের এই প্রবাহকে যদি আমরা পানির সঙ্গে তুলনা করি, দূষিত পানি থেকে বিশুদ্ধ পানি বের করাই হবে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা। বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পানির পরিমাণ বাড়ানোই হবে আমাদের কর্তব্য। এটাই আমাদের লক্ষ্য। কীভাবে আমরা তরুণদের কাছে পৌঁছাব? প্রথমত, তরুণদের বুঝতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। তারা কী চায়, সেটা বের করতে হবে। এ সম্পর্কে তথ্যাদি জোগাড় করতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে আমরা যে অসংখ্য তথ্য পাই, তা কীভাবে ব্যবহার করব, সেটাও জানতে হবে। শিল্প হিসেবে আমাদের একসঙ্গে কিছু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সবাইকে এক ছাঁচে ফেললে হবে না। শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণদের, যাদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, তাদের চাহিদার সঙ্গে বয়স্ক, গ্রামের গরিব ও নারীদের চাহিদা মিলবে না। সেকেলে ধারার সংবাদপত্রের চরিত্র হলো সবার জন্য একই ধাঁচের। সম্পাদক ঠিক করেন, কোনটি ছাপা হবে আর কোনটি হবে না।

প্রশ্ন

গণমাধ্যমের মডেল নিয়ে আপনাদের কোনো গবেষণা আছে?

লার্জ টেলার্ট: প্রত্যেকেই গবেষণা করছেন। এখানেও গবেষণা হয়েছে এবং এতে যা বেরিয়ে এসেছে, তা হলো সবখানে এক নিয়ম চলবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতা সুইডেনের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন। সে ক্ষেত্রে এটা বলা কঠিন যে এটাই উত্তম সমাধান। আপনারা আপনাদের পাঠক-শ্রোতা সম্পর্কে জানেন, কীভাবে তথ্য ব্যবহার করবেন, সেটাও জানা। একই সঙ্গে জানা আছে, ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যাবে।

প্রশ্ন

প্রচলিত গণমাধ্যমের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের কী করণীয়। একসময় গণমাধ্যমের মধ্যে ছিল প্রিন্ট, এখন এর সঙ্গে অনলাইন, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে।

লার্জ টেলার্ট: এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন। আমাদের দুই ধারায় এগোতে হবে। এক ধারা হলো দীর্ঘদিন ধরে যেই মাধ্যমে ব্যবহার করছি, প্রিন্ট, সেটাও চালু রাখতে হবে। সেই সঙ্গে কীভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যাবে, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। এটি সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য, যেখানে প্রিন্ট মিডিয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। অতএব আপনাকে দুই ধারা নিতে হবে। একটি দীর্ঘ মেয়াদে। আরেকটি ২০২৩ সালের জন্য, যা আমাদের সবার জন্যই কঠিন বছর।

প্রশ্ন

২০২৩ সাল কেন গণমাধ্যমের জন্য কঠিন সময়?

লার্জ টেলার্ট: এ বছর সবার জন্য কঠিন হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, অন্যান্য পণ্য—সবকিছুর দাম বাড়ছে। জনগণ বিক্ষোভ করছে। তাদের হাতে কম টাকা আছে এবং নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে। সুইডেনে হয়তো বেশিই। আমরা সবাই ইউক্রেন যুদ্ধের তাপ অনুভব করছি। পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই এসব ঘটছে।

প্রশ্ন

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মতো দেশগুলোর পার্থক্য আছে। আমাদের এখানে গণমাধ্যমের লাগাম টেনে ধরতে নানা রকম নিবর্তনমূলক আইন আছে।

লার্জ টেলার্ট: হ্যাঁ, আমরা সুইডেনে মতপ্রকাশের ব্যাপক স্বাধীনতা ভোগ করি এবং সুইডিশ মিডিয়া ন্যায়পাল সব সময় বলে থাকেন, মুক্ত সাংবাদিকতাই দুর্নীতি বন্ধের উত্তম উপায়। আমি মনে করি, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে পেশাগত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা হলো মৌলিক ভিত্তি। আদর্শ অবস্থা হলো উদার গণমাধ্যম আইন, যেখানে গণমাধ্যমে নিজেই পেশাগত নীতিমালা মেনে চলবে; যা তাদের দায়িত্বশীল করবে। নিবর্তনমূলক আইন মোকাবিলা খুবই কঠিন। তবে এর সেরা উপায় হলো ভালো সাংবাদিকতা করা। খুব সরল উত্তর। যদি আমরা ভালো সাংবাদিকতা করি, যদি আমরা পেশাদার হই এবং যদি সঠিক তথ্য পরিবেশন করি, আমরা যদি ভালো রিপোর্ট করি, তাহলে সাংবাদিকতা মজবুত হবে।

প্রশ্ন

পেশাগত কাজে আপনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

লার্জ টেলার্ট: আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে বহু স্বাধীন সাংবাদিক সত্যিই ভালো সাংবাদিকতা করছেন এবং তাঁরা সাহসী। এই মুহূর্তে অন্য যেকোনো দেশের মতো আমাদের অবশ্যই সৃজনশীল হতে হবে এবং এটা সহজ নয়। আমি সাংবাদিক হিসেবে আশির দশকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং আশি ও নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিকতা করেছি। এখন আমি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমাদের অবশ্য মনোভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। এটা সব দেশের সাংবাদিকদের জন্যই কঠিন কাজ। আমার ধারণা, কেবল বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই অনেক সাংবাদিক পুরোনো রীতি আঁকড়ে আছেন। কিন্তু আমাদের এখন আর এই চিন্তা করলে চলবে না। কেননা আমরা তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছি না। আমরা বিশাল তথ্যপ্রবাহের অংশ, যেখান থেকে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা বের করে আনতে হবে। বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। আমাদের পুনশ্চিন্তা করতে হবে। এটা সর্বত্রই চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন

ভুল তথ্য, অপতথ্য, ভুয়া খবর সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভুয়া খবর মোকাবিলার উৎকৃষ্ট পথ কী?

লার্জ টেলার্ট: এসব তথ্য যাচাই করা, বিশেষ করে যেগুলো ভাইরাল হয়ে যায়। সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভুল তথ্য দেওয়া হয়। আর অপতথ্য প্রচারের কৌশল হলো নিজের পক্ষে জনমত আনা এবং অন্য পক্ষের মতামতের বিরোধিতা করা। মনে রাখতে হবে, দুটোই ভুয়া। এরপর আপনি যা আলোচনা করবেন, সেটাও ভুয়া হবে। স্বাভাবিকভাবে জনগণে জিজ্ঞাসা করবে, কোনটা আমি বিশ্বাস করব? এর উত্তর হলো আমি কোনোটাই বিশ্বাস করতে পারি না। কেননা তারা উভয়ই মিথ্যা বলছে। যদি আমরা অপতথ্যের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি, আমরা বোকা বনে যাব। অতএব আমাদের মানসম্পন্ন সাংবাদিকতাই করে যেতে হবে। যখন মানুষ বিভ্রান্ত হবে, তখন তারা দেখতে চাইবে, মানসম্পন্ন সংবাদমাধ্যমে কী তথ্য এসেছে, সেটাই তারা বিশ্বাস করবে। তারা মানসম্পন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছেই আসবে এবং আস্থা রাখবে। আমাদের এটাই ধরে রাখতে হবে।

প্রশ্ন

সাংবাদিকতায় নারীর ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন? বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনেক বেশি নারী এসেছেন। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আসা নারী সাংবাদিকের সংখ্যা সীমিত। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

লার্জ টেলার্ট: আমরা যখন টেকসই সাংবাদিকতার কথা বলি, তখন মনে রাখতে হবে, জেন্ডার সমতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। এটা কেবল তাদের অধিকারের বিষয় নয়। যদি জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী হন, তাহলে আমাদের তাঁদের চাহিদাটাও জানা প্রয়োজন।এর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিষয়ও আছে। আপনাদের এখানে অনেক মধ্যশ্রেণি থেকে উঠে আসা নারী আছেন, যাঁরা শুধু রান্নার বিষয় জানতে চান না। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়েও জানতে আগ্রহী। সুইডেনে নারী সাংবাদিকদের অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। সেখানে পুরুষের চেয়ে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ভালো হলো সংখ্যার ভারসাম্য থাকা। অন্যদিকে যদি গবেষণার প্রতি আলোকপাত করি দেখা যাবে, কেবল গণমাধ্যম নয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী ও পুরুষের সমতা আছে, তারা ভালো কিছু করতে পারে পুরুষপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠান থেকে। অতএব, জেন্ডার সমতার বিষয়টি বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক। একই কথা প্রযোজ্য তরুণদের সম্পর্কেও। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়স ২৫–এর নিচে। কিন্তু সাংবাদিকদের বয়স দেখলে তাদের প্রতিনিধিত্ব কত ভাগ? অতএব আপনার বার্তাকক্ষের প্রতিনিধিত্বও জনসংখ্যার অনুপাতে হতে হবে।

প্রশ্ন

টেকসই গণতন্ত্র ছাড়া কি টেকসই সাংবাদিকতা টিকে থাকতে পারে?

লার্জ টেলার্ট: না, পারে না। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের জানতে হবে, আমরা কতটা প্রভাবিত করতে পারি, কতটা পারছি না। উদাহরণ হিসেবে আমি উল্লেখ করতে পারি, যেকোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান অধিক নারী ও তরুণ সাংবাদিককে নিয়োগ দিতে পারে। এটা তো আমরা করতে পারি। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রভাবিত করা হয়তো কিছুটা আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। আমরা এটা সব সময়ই করতে পারি। আবার আমরা এক দিনে সেটা করতে পারব না। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমরা কিছু করতে পারি সব সময়ই।

প্রশ্ন

আপনি কি মনে করেন, সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র রক্ষার কর্মী হতে পারেন?

লার্জ টেলার্ট: আমি মনে করি, সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্টের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা সাংবাদিক হিসেবে গণতন্ত্র বিকাশে কাজ করি। স্বাধীন সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র চলতে পারে না। অতএব, আমরা গণতন্ত্রেরই অংশীজন। স্বাধীন ও মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র চর্চা করা কঠিন। পৃথিবীর কোথাও খাঁটি গণতন্ত্র নেই। এমনকি সুইডেনেও নয়। গণতন্ত্রে সাংবাদিকদের দুটো কাজ রয়েছে। প্রথমত ভালো সাংবাদিকতা করা এবং সেটি বজায় রাখতে সংগ্রাম করে যাওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কাজ পাঠক-দর্শকদের জানা এবং তারা কী চায়, কী তাদের প্রয়োজন, সেটা মেটানোর চেষ্টা করা। আমরা যদি টেকসই সাংবাদিকতার কথা বলি, তাহলে কেবল সমস্যা তুলে ধরলে হবে না, সমাধানের দিকেও তাকাতে হবে। কিন্তু আমরা কোনো সমাধানের প্রস্তাব দেব না। আমরা যখন কারও সাক্ষাৎকার নেব, তখন কেবল সমস্যার ওপর জোর না দিয়ে তার সমাধানের কথাও জানতে চাইব। আপনি যদি ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির আওতায় আনতে চান, সমাধানের কথাও জিজ্ঞাসা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাধরেরা দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা প্রশ্ন করব, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা কীভাবে খাপ খাইয়ে চলব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোন শস্য আমরা ফলাতে পারব, জীবনযাত্রা কীভাবে খাপ খাইয়ে চলব? তরুণ পাঠক-দর্শকেরা সমাধানও চায়। আমরা কেবল সমস্যার কথা বললে তারা এড়িয়ে চলবে।

প্রশ্ন

আপনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেমন মনে হয়েছে তাঁদের?

লার্জ টেলার্ট: আমাদের মধ্যে খুব ভালো আলোচনা হয়েছে এবং আমি সত্যিই অভিভূত। তারা সবাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে খুবই কৌতূহলী আলোচনা হয়েছে, যা সুইডেনে লিননাস ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও হয়নি। এই তরুণদের (বাংলাদেশি) কথা আমাদের শুনতে হবে। তারা বাস্তবতা বোঝে। তারা প্রযুক্তি বোঝে। অবশ্যই তাদের জগৎ ভিন্ন। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে রাজনৈতিক ফুটবল খেলা হচ্ছে, তা নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহের জায়গা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা যদি তাদের আস্থা ও ভরসা অর্জন করতে চাই, তাহলে তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের উপেক্ষা করা যাবে না।

প্রশ্ন

জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান নগণ্য হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সাংবাদিকতা কীভাবে এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে পারে?

লার্জ টেলার্ট: জলবায়ু সাংবাদিকতা সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তন খুবই অনিশ্চিত বিষয়। আমরা সাধারণত বিজ্ঞানীদের কাহিনি বলি, তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ার কথা বলি। কিন্তু তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ বা ২ দশমিক ৫ হলো, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কিছু আসে যায় না। ভালো সাংবাদিকতা হলো তাদের জীবন তুলে ধরা। দৈনন্দিন জীবনে কী করতে হবে, সেটা তারা জানতে চায়। কপ–২৭ বা শার্ম আল–শেখে কত মানুষ গেল, সেসব নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা জানতে চায় ফসলের কতটা ক্ষতি হলো, মাছের ক্ষতি হলো, ঢাকার ধোঁয়া জীবনকে কতটা বিপন্ন করল। তাদের শিশুদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? আমাকে কি সুন্দরবন থেকে চলে যেতে হবে? কিংবা চলে যেতে হলে সেখানে কী করব? আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা আছে যে সব রিপোর্টই ফুটবল খেলার মতো করা, বিশ্বকাপ তো খুবই রোমাঞ্চকর ঘটনা যখন চ্যাম্পিয়নশিপ, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নিয়ে কথা বলি। কিন্তু জীবন তো ফুটবল খেলা নয়। এটা হলো কীভাবে আমরা বাস্তবতা বদলে দিতে পারি। আমরা জানি, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। অতএব, গণমাধ্যমের উচিত এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশেষ কৌশল নেওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। দ্রুত এটা বাড়বে। এর সম্ভাবনা কোথায় কোথায় আছে, সেটাই মানুষ জানতে চায়, কেবল সমস্যার কথা শুনতে চায় না। এ পথেই আমাদের যেতে হবে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

লার্জ টেলার্ট: আপনাদেরও ধন্যবাদ।