রাস্তায় বিএনপির ‘তাফালিং’ ও নদীতে পুলিশের ঝাঁপ

মিছিল নিয়ে এগোচ্ছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পুলিশের এক কর্মকর্তা একটি মিছিলের ব্যানার ধরে টান দেন। সেখান থেকেই সূত্রপাত সংঘর্ষের। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর
ছবি: প্রথম আলো

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অতি হক কথা বলেছেন, ‘রাস্তা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়।’ কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘রাস্তা কারও একার নয়।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বামপন্থী কবির কথা প্রায় সমার্থক হলেও বলার উদ্দেশ্য এক নয়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলতে চেয়েছেন, রাস্তা দখল করে রাখা যাবে না। ছেড়ে দিতে হবে। আর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রায় চৌদ্দ বছরে ধরে দখলে রাখা রাস্তায় অন্য কেউ ভাগ বসাবে সেটা চান না। কেননা বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় থাকেন, ঘরবাড়ি-দালানকোঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য নদী-খাল-বালুমহাল-রাস্তা তাদের দখলে থাকে। আজ যেমন আওয়ামী লীগ রাস্তার দখল ছাড়তে চায় না, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তারাও দখল ছাড়তে চায়নি। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও হয়তো ছাড়তে চাইবেন না।

সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে বিএনপির সমাবেশ ও মিছিলকে কেন্দ্র করে রাস্তায় সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে। হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আবার কোথাও বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও পালন করতেও দেওয়া হচ্ছে। নরমে গরমে এগোচ্ছে সরকার। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এক কণা ছাড় দিতে নারাজ। রাস্তা এত দিন তাদের দখলে ছিল। এখনো থাকবে। কেউ ভাগ বসাতে পারবে না।

এত দিন আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিএনপির কোনো রাজনীতি নেই। তারা দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি নিয়ে অহেতুক শোরগোল তুলছে। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলছে না। কিন্তু অধুনা যখন বিএনপি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কর্মসূচি নিল, তখন বলা হলো, এর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্র’ আছে।  দেশের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইন আছে। ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করতে হবে। অভিযোগের পক্ষে অকাট্য তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অত সব মানতে চাইছে না। তারা দেশ ও সরকারকে একাকার করে ফেলছে। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা, তাদের কোনো কাজের সমালোচনা করা যে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়, এটা কে বোঝাবে? আজ আওয়ামী লীগের নেতারা যে ভাষায় কথা বলেন, বিএনপির নেতারাও ক্ষমতায় থাকতে একই ভাষায় কথা বলতেন।

আসলে এটা দলের দোষ নয়, ক্ষমতার দোষ। ক্ষমতায় থাকলে তারা রাতকে দিন দিনকে রাত করতে পারেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কথা শুনলে মনে হয়, তারাই রাস্তার মালিক, সেখানে তারা চাইলে সমাবেশ করবেন, না চাইলে করবেন না।  বিএনপি সেখানে আসতে পারবে না। কিংবা একান্তই যদি আসে, আমাদের অনুকম্পায় আসতে হবে।

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপি কর্মীদের অবস্থান। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর

বিএনপি যেদিন নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে ও বনানীতে মোমবাতি প্রজ্বালনের কর্মসূচি নিল, আওয়ামী লীগের দ্বৈত ভূমিকায় দেখলাম আমরা । নয়াপল্টনে বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করল। কোনো সমস্যা হলো না। সমস্যা হলো বনানীতে। সেখানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ‘নাশকতা’ খুঁজতে গিয়ে বিএনপির মিছিলে হামলা চালালেন। তারা জানেন, হামলা করলে বিএনপিও প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। তখন দুই পক্ষে  হাতাহাতি লাঠালাঠি হবে।  ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটবে। সেই অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘শান্তি রক্ষায়’ এগিয়ে আসবে। আর দেশের মানুষকে দেখানো হবে, বিএনপি কর্মসূচি দিলেই গোলমাল হয়, সম্পদের ক্ষতি হয়, হতাহতের ঘটনা ঘটে। অতএব, তাদের রাস্তার বাইরে থাকাই শ্রেয়।  ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও একটি কথা বলেছেন, ‘আপনারা তাফালিং করবেন, আর আমরা ঘরে বসে আঙুল চুষব, তা ভাববেন না।’ তাফালিং শব্দের অর্থ ঝামেলা করা, ঝঞ্ঝাট করা, মাস্তানি, বেপরোয়া কাজকর্ম করা ইত্যাদি। এখন দেশবাসীই বিচার করবে রাস্তায় তাফালিং কারা করছে? কারা কখনো দেশীয় ও কখনো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। নিজেদের শক্তি দেখাচ্ছেন?

বিএনপির কোনো নেতা  আওয়ামী লীগকে রাস্তায় নামতে না দেওয়ার কথা বলেছেন বলে শুনিনি। বরং তারা বহু স্থানে  গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে  ১০/১৫মিনিটের ঝটিকা মিছিল করে রাস্তা ছেড়ে দেন।  তাহলে রাস্তা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, কথাটি কেন এল? এল এ কারণে যে এটি ক্ষমতাসীনেরা যেমন করে চান, তেমন করেই ব্যবহার করবেন। প্রথম আলোর পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের অফিসের চার পাশে ব্যারিকেড বসিয়ে  ঘিরে রাখা হতো। তারও আগে আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির অফিসের সামনেও একই দৃশ্য দেখা যেত। সে সময় দলীয় অফিসের বাইরের প্রায় সব রাস্তাই বিরোধী দল মিছিল সমাবেশ করতে পারত।

যেসব দেশে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা আছে, সেসব দেশে রাস্তা নয়, জাতীয় সংসদই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা হয়। উভয় পক্ষ যুক্তিতর্ক তুলে ধরে। আমাদের রাজনীতিকেরা সবকিছু রাস্তায় সমাধান করতে চান। প্রতিপক্ষকে কেবল পরাজিত নয়, পর্যুদস্ত করেই নিজের বিজয় অর্জন করতে চান। এখন না হয় সুষ্ঠু ভোট  হয় না। যখন  সুষ্ঠু ভোট হতো তখনো মেয়াদের অর্ধেক সময় বিরোধী দল লাগাতার সংসদ  বর্জন করেছে। আবার ৯০ কর্মদিবসের এক দিন আগে সংসদে গিয়ে বেতন-ভাতা তুলে নেওয়ার নজিরও আছে।  

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের পর সাবেক এক যুবদল নেতার সুতার কারখানায় আগুন। এ ঘটনার জন্য পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মোস্তফা এবং তাঁর কর্মীদের দায়ী করেছেন ওই যুবদল নেতা

রাস্তা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয় এ কথা সবাই জানেন।  কিন্তু সেই রাস্তাকে ‘পৈতৃক সম্পত্তির’ মতো ব্যবহার করলে কী হয়, বুধবার মুন্সিগঞ্জে দেখেছি।  বিএনপির দাবি, মুক্তারপুরে তারা সমাবেশ ডেকেছিল , পুলিশের অনুমতি নিয়েই। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা একটি মিছিলের ব্যানার ধরে টান দিলে দুই পক্ষে প্রথমে বাগ্‌বিতণ্ডা  হয়, এরপর সংঘর্ষ। একপক্ষ ইটপাটকেল ছোড়ে, আরেক পক্ষ গুলি। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।  ৬৮জন আহত হয়েছেন। গুলিতে চরমভাবে আহত হন যুবদল কর্মী শাওন ভূঁইয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন পর মারা যান তিনি।

বুধবার বিএনপির নেতা-কর্মীদের মারে টিকতে না পেরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। এ ভাষ্য পুলিশেরই। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, মুন্সিগঞ্জে বিএনপির বরাবরই দুই গ্রুপ ছিল। ওই দিনও তারা আলাদা আলাদা মিছিল নিয়ে তারা বিতণ্ডায় জড়িয়েছে। আবার বাধা পাওয়ার পর তারা এক হয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছে।

শুধু মুন্সিগঞ্জে নয়, সারা দেশেই বিএনপির মধ্যকার বিরোধ-বিভক্তি ঘুচিয়ে দিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ একযোগে কাজ করছে। ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা যে বিএনপি নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মেটাতে পারেনি, সেটাই কখনো আওয়ামী লীগ হামলা করে, কখনো পুলিশ লাঠিপেটা করে মিটিয়ে দেয়। এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে তারা ধন্যবাদ পেতে পারেন। মুন্সিগঞ্জে ঘটনায় মনে হলো বিএনপি এখন আর মুখ বুজে মার খেতে প্রস্তুত নয়। মার খেয়ে তারাও মার দিতে প্রস্তুত আছে। তারাও বুঝে গেছে রাস্তা স্বেচ্ছায় ছেড়ে না দিলে রাস্তা দখল করত হবে।

রাস্তা নিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটির একাংশ তুলে ধরছি। যারা রাস্তা দখল করে রাখতে চান তাদের বোধোদয়ের জন্য কাজে লাগতে পারে।

ধর্ম যত দিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, তত দিন
রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না। রাস্তা কারও
একার নয়।
বরং তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়, যার স্পর্ধা আকাশ
ছুঁয়ে যায়।
বিজ্ঞান যখন প্রেমের গান ভুলে ভাড়াটে জল্লাদের পোশাক গায়ে চাপায়, আর
রাজনীতির বাদশারা পয়সা দিয়ে তার ইজ্জত কিনে নেয়,
আর তার গলা থেকেও ধর্মের ষাঁড়েদের মতোই কর্কশ
আদেশ শোনা যায়: ‘রাস্তা ছাড়ো! নইলে—
পৃথিবীর কালো সাদা হলুদ মানুষের গান, তাদের স্বপ্ন
এক মুহূর্ত সেই চিৎকার শুনে থমকে তাকায়।
তারপর যার যেদিকে রাস্তা, সেদিকে মুখ করেই তারা সামনে,
আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কেউ কারোকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না, যত দিন এই পৃথিবীতে গান থাকে,
গানের মানুষ থাকে, স্বপ্ন থাকে...।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি