মতামত

গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন কি টেকসই হতে পারে?

গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি শুধু আমলাশ্রেণি ও প্রতিষ্ঠানই কলুষিত করে না, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়। এটি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করে দেয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন পুলিশ বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদি, যা রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য।

দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা, যা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থাগুলো একাধিকবার উল্লেখ করেছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘দ্য কোয়ার্টারলি জার্নাল অব ইকোনমিকস’–এ ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত পাওলো মাওরো তাঁর নিবন্ধে দুর্নীতি বিষয়ের আলোচনায় বাংলাদেশের উদাহরণ টানেন। বলেন, বাংলাদেশের দক্ষতা ও শুদ্ধাচারের সূচক মাত্র এক ধাপ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।

ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট দুর্নীতি বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে চালিত জরিপ থেকে একই তথ্য প্রকাশ করেছে। বস্তুত, দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলছে। দুর্নীতিবাজেরা কীভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করছে, এর কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তারা এমন সব অনুৎপাদনশীল প্রকল্প হাতে নেয়, যা থেকে অর্থ তছরুপ করা সহজ (শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য অনুৎপাদনশীল প্রকল্পই মূলত দায়ী), দুর্নীতি অর্থ পাচার ঘটায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ করে দেয়, বড়লোকদের সম্পদ বৃদ্ধির ‘চুইয়ে পড়া’ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে এবং অর্থ খাত ও পুঁজিবাজারকে রুগ্‌ণ করে।  

গণতন্ত্রহীনতা দুর্নীতির বেশে আবির্ভূত হবেই। কোনো কিছুই এটা ঠেকাতে পারবে না। একমাত্র একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ, এ রকম পরিবেশেই রাজনীতিকেরা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। পক্ষান্তরে, আমলার কোনো জবাবদিহির বালাই নেই। আবার রাজনীতিক ও আমলার মধ্যকার যোগসাজশই দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে।

এ অবস্থায় রাজনীতিক ও আমলার মধ্যে যোগসাজশ হবে, যদি রাজনীতিক (মন্ত্রী বা এমপি) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত না হন। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, নির্বাচনটা যদি প্রকৃত না হয়, তবে রাজনীতিকের জবাবদিহি থাকে না।

গণতন্ত্র ছাড়া ‘সবার জন্য উন্নয়ন’ নিশ্চিত করা যায় না বলেই অমর্ত্য সেন কমিউনিস্ট ব্যবস্থা সমর্থন করেননি। তাঁর ‘দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা’ বইয়েও তিনি গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। প্রফেসর সেন গণতন্ত্রকে একটি শাশ্বত মূল্যবোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে থাকবে বহু দল ও নির্বাচন এবং বিরোধী দলের সমালোচনা যার অপরিহার্য অংশ—এমন একটি ব্যবস্থাই পারে দুর্ভিক্ষ রোধ করতে। তাঁর ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ গ্রন্থেও তিনি একই অভিমত প্রকাশ করেন এবং উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের উপস্থিতি যে জরুরি—এ কথা জোর দিয়ে বলেন।

দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে আর গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। গবেষণাগুলোর মূল বক্তব্য মোটামুটি একই রকম—যেমন গণতন্ত্র ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ করা অসম্ভব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য, সুশাসন মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে ইত্যাদি।

সম্প্রতি ‘জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’তে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এমআইটির প্রভাবশালী অধ্যাপক ডারোন এসিমগ্লু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৭৫টি দেশের ওপর যে গবেষণা পরিচালনা করেছেন, তাতে মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারের ওপর গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পান। শুধু তা-ই নয়, এ প্রভাব উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরনির্বিশেষে সত্য এবং পুঁজি, বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগের সঙ্গে যা বাড়তে থাকে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই একসময় সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট ব্যবস্থা চালু ছিল। কিউবা ও উত্তর কোরিয়া ছাড়া আর কোনো দেশে এ ব্যবস্থা আর বহাল নেই। রাশিয়াসহ সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত সব প্রজাতন্ত্রই এখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী। চীনে একদলীয় শাসন ছাড়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর কোনো উপাদান অবশিষ্ট নেই। সর্বহারার একনায়কত্ব একটি চমৎকার দর্শন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো, যখন পার্টির নেতা-কর্মীরা আর সর্বহারা হতে রাজি থাকলেন না, অর্থাৎ পার্টির সদস্যরা যখন সম্পদ ও উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হতে চাইলেন।

দেশে যখন গণতন্ত্র বা বহুদলীয় ব্যবস্থা নেই, পার্টি ভেতরেও যখন গণতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত, নেতারা যখন আমলাদের মতো আচরণ করেন এবং শত অভিযোগ সত্ত্বেও নেতা পরিবর্তনের কোনো প্রক্রিয়া নেই, তখন দুর্নীতির আগমন ঘটতে বাধ্য। কারণ, দুর্নীতিই পারে পার্টির নেতাদের সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিক হতে সাহায্য করতে। বস্তুত, পরবর্তী বংশধরেরাও যাতে পুরুষানুক্রমে তাঁদের আহরিত সম্পদ ভোগ করে যেতে পারে, এ রকম একটা নিষ্কণ্টক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টি নেতারাই সোভিয়েতের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন।

একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জবাবদিহির পরিবর্তে টাকা বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। কারণ, টাকা হলেই তিনি পার্টির মনোনয়ন পাবেন এবং ভোট কিনতে পারবেন। দুর্নীতি করলে যেহেতু শাস্তি হয় না, তাঁর জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তিনি মনে করেন। ভোটারবিহীন নির্বাচন বা সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন, দুই ক্ষেত্রেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন—এই মনস্তত্ত্ব দ্বারাই সংসদ সদস্যরা তাড়িত।

জ্যাঁ পল সার্ত্রের কমিউনিজমে বিশ্বাস সর্বজনবিদিত। তিনি আমৃত্যু কমিউনিজমে আস্থাশীল ছিলেন, তবে তিনি স্তালিনের নীতির সমালোচক ছিলেন এবং কমিউনিজমকে একটা মানবিক রূপ দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি যে কিউবাকে এতটা সমর্থন করতেন, এর কারণ কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল। কিউবাতে পার্টি কংগ্রেসের আগে সারা দেশে খোলা মাঠে ও দেয়ালের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯১ সালের কংগ্রেসে এ রকম ৮৯ হাজার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরের ও বাইরের সব মিলিয়ে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন কিউবান অংশ নিয়েছিলেন। এখানে পার্টির বাইরে থেকে যে কেউ পার্টির বা পার্টির কোনো নেতার বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ তুলতে পারেন। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজনকে তাঁর কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। কিউবা সম্পর্কে যে কথাগুলো বলা হলো, এর কেন্দ্রীয় বার্তা হলো গণতন্ত্র—অর্থাৎ গণতন্ত্র ছাড়া, বিরোধী পক্ষ ছাড়া, চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেজ তথা ভারসাম্য ছাড়া দুর্নীতি দেখা দিতে বাধ্য।

বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর আত্মজীবনীর মুখবন্ধে তিনটি প্রেষণার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হলো বিপন্ন মানবতার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। সম্ভবত সে কারণেই তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রতিনিধি হয়ে ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সমাজতন্ত্রের প্রতি মোহভঙ্গ না হলেও সেই সময়ের সোভিয়েত মডেল তাঁর ভালো লাগেনি। বাক্‌স্বাধীনতা, বিরোধী দলের অস্তিত্ব ও তাঁদের সমাবেশ করার স্বাধীনতা ছাড়া এই যে ব্যবস্থা, এ থেকে জন্ম নেয় স্বৈরাচার, যা বার্ট্রান্ড রাসেল নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এক মাসের ভ্রমণ শেষে তিনি তাঁর ডায়েরি যা লিখলেন, তা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির দেশ, বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকটা একই অবস্থা বিরাজ করছে। তিনি লিখেছেন, ‘একনায়কতন্ত্রের সমস্ত কলাকৌশল দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। বিরোধী দলের এমনকি অন্য বাম দলগুলোরও কথা বলার ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত।’

বাথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জো ডেভাইন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গল্পকে প্রকৃত উন্নয়ন বলতে নারাজ। এর কারণ হয়তো এ–ই, এ উন্নয়ন মুষ্টিমেয় লোকের পকেট ভারী করেছে। বাংলাদেশ যখন ইতিমধ্যেই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে, তখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ডেভিড লুই তাঁর বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি বইয়ে বাংলাদেশের সুশাসনের মারাত্মক অভাব ও সীমাহীন দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, পার্লামেন্টারি সিস্টেমের সুফল বাংলাদেশে অনুপস্থিত। প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও দুর্নীতির সূচকে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার মানে হলো, যেটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে হচ্ছে, এটা আদতে নকল গণতন্ত্র। কারণ, গণতন্ত্রের মূল কথা হলো জবাবদিহি।

একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জবাবদিহির পরিবর্তে টাকা বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। কারণ, টাকা হলেই তিনি পার্টির মনোনয়ন পাবেন এবং ভোট কিনতে পারবেন। দুর্নীতি করলে যেহেতু শাস্তি হয় না, তাঁর জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তিনি মনে করেন। ভোটারবিহীন নির্বাচন বা সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন, দুই ক্ষেত্রেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন—এই মনস্তত্ত্ব দ্বারাই সংসদ সদস্যরা তাড়িত।

  • ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com