যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আরশট-রক) সারা বিশ্বে সাতজন চিফ হিট অফিসার তারা নিয়োগ করেছে। বুশরা আফরিন তাঁদের একজন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আরশট-রক) সারা বিশ্বে সাতজন চিফ হিট অফিসার তারা নিয়োগ করেছে। বুশরা আফরিন তাঁদের একজন।

চিফ হিট অফিসারকে নিয়ে সমালোচনা কতটা যৌক্তিক?

চারদিকে প্রচণ্ড গরম। আবহাওয়া বৈরী। কাজের জন্য দৈনিক যাঁদের পথে নামতে হয়, তাঁদের অবস্থা খারাপ। ঘরে যাঁরা থাকেন, রান্নাবান্না-ঘরকন্না সামলান, তাঁদের অবস্থাও ভালো নয়।

হিট অ্যালার্ট জারি হওয়ার পর স্কুল-কলেজ পর্যন্ত সপ্তাহখানেক বন্ধ ছিল। মোদ্দাকথা, গ্রীষ্মের এই কাঠফাটা গরমে সবারই ত্রাহি মধুসূদন দশা।

গণপরিবহনে যাঁরা যাতায়াত করেন বা দিনের অনেকটা সময় রাস্তায় থাকেন, তাঁরা খেয়াল করে দেখবেন, একটুতেই ধুন্ধুমার বাগ্‌যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে। এমন গরমে সবার মাথা গরম। যুক্তি, বুদ্ধি ও সহনশীলতা আর খুব একটা কাজ করছে না।

এমন গরমের সঙ্গে তো আর যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু মানুষের রাগ ঝাড়ার একটা জায়গা লাগে। গত বছর থেকে ঢাকার লোকের সেই ব্যবস্থাও হয়েছে—‘চিফ হিট অফিসার’।

হিট অফিসার কেন এই ‘হিট’ কমাতে পারছেন না, সেই রাগে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করে ফেলছেন লোকজন। হিটই যদি কমাতে না পারেন, তাহলে আর হিট অফিসার রাখা কেন, এমনই প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেনরা।

নেটিজেনদের দাবি, যেহেতু হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাহলে কেন গরম কমছে না? অনেকে তো এমন প্রশ্নও তুলেছেন, জনগণের টাকায় বেতন নিয়ে এক্ষুনি কেন গরম কমিয়ে দিচ্ছেন না হিট অফিসার।

যদিও হিট অফিসারের বেতন সিটি করপোরেশন দেয় না; দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আরশট-রক)। জানা যাচ্ছে, সারা বিশ্বে সাতজন চিফ হিট অফিসার তারা নিয়োগ করেছে।

এখন দেখা যাক, নেটিজেনদের এই চাওয়া কতটা যৌক্তিক। প্রথমত, রাতারাতি ঢাকার গরম কমিয়ে ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার জন্য সময় লাগবে।

দ্বিতীয়ত, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যে শহরটিকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলা হয়েছে, সেটাকে দু–এক বছরে ঠান্ডা শহর বানানো একটা অলীক আবদার।

নেটিজেনরা বলছেন, হিট অফিসার যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা সবাই জানেন। এই পরামর্শ দেওয়ার কোনো মানে নেই।

আসলে কি কথাটি সত্য? বুশরা আফরিন যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ জানেন, এটা সত্যি। কিন্তু দুই কোটির বেশি জনগোষ্ঠীর শহরের সবাই এই বিষয়গুলো জানেন, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

আর যাঁরা জানেন, তাঁরা কি মেনে চলেন? আমরা কি জানি না রাস্তায় চিপসের প্যাকেট ফেলা ভালো নয়, আমরা কি জানি না যত্রতত্র কোল্ড ড্রিংকসের বোতল ও থুতু ফেলা ঠিক নয়?

কিন্তু রাস্তায় বের হলে কি কোনোভাবে বোঝা সম্ভব যে আমরা বিষয়গুলো জানি? জানা ব্যাপারগুলোই বারবার বলা হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে।

চিফ হিট অফিসারের কাজই মূলত সচেতনতামূলক। তিনি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোকেও পরামর্শ দেবেন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করবেন।

কথা উঠেছে, গত বছর তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের উদ্যোগে ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় গাছ কাটা হয়েছে; তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করেছেন কি না।

আমরা জানি, একটি পরিণত গাছ কেটে ফেলা হলে তার অভাব পূরণ করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। ধরে নেওয়া হয়, গড়ে ১০টি গাছ রোপণ করলে তার মধ্যে একটি গাছ পরিণত হয়। যদি তিনি ওই সময়টাতে কিছু না করে থাকেন, তাহলে তাঁর সমালোচনাটা যৌক্তিক।

বোধ করি, চিফ হিট অফিসার নারী হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনাটা বেশি। যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা হয়তো জানেন না এই পদে শুধু নারীদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়।

চিফ হিট অফিসার প্রকল্পের পরিকল্পনাটা এসেছে আরশট-রক সেন্টারের পরিচালক ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলর্ডের মাথা থেকে। তিনি বলেন, এই পদে শুধু নারীদের নির্বাচিত করা হয়। কারণ, চরম তাপমাত্রার বড় শিকার নারী ও মেয়েশিশুরা।

চিফ হিট অফিসারের কাজকর্ম নেটিজেনদের কাছে দৃশ্যমান না হলেও তাঁর উদ্যোগ কিন্তু থেমে নেই। বুশরা আফরিন শুধু বাংলাদেশের প্রথম চিফ হিট অফিসার নন, এশিয়ারও প্রথম চিফ হিট অফিসার।

গত বছর ৮০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর আরও ১ লাখ ২০ হাজার গাছ লাগানো হবে। গাছগুলো লালন-পালনের জন্য নগরবাসীর সহায়তা প্রয়োজন। গতকাল শনিবার ঢাকা উত্তর সিটি দুটি স্প্রে ক্যানন, ১০টি ওটার বাউজার গাড়িতে করে বিভিন্ন সড়কে পানি ছিটানোর কাজ করছে। পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমে ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ড এলাকায় বিনা মূল্যে খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে। সিটি করপোরেশন এই কাজগুলো করছে চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে।

গত বছর নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পানীয় জলের সুব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য।

একই সঙ্গে ‘কুলিং স্পেস’-এর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেন পথচারীরা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান।

আমাদের অবশ্যই আরও বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে।

গত বছর ৮০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর আরও ১ লাখ ২০ হাজার গাছ লাগানো হবে।

গাছগুলো লালন-পালনের জন্য নগরবাসীর সহায়তা প্রয়োজন। গতকাল শনিবার ঢাকা উত্তর সিটি দুটি স্প্রে ক্যানন, ১০টি ওটার বাউজার গাড়িতে করে বিভিন্ন সড়কে পানি ছিটানোর কাজ করছে।

পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমে ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ড এলাকায় বিনা মূল্যে খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে। সিটি করপোরেশন এই কাজগুলো করছে চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে।

তাহলে চিফ হিট অফিসার কাজ করছেন না, এমন অভিযোগ তো অমূলক। যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা একটু খোঁজখবর নিলেই বিষয়গুলো জানতে পারতেন।

হয়তো মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি, তাঁরা আরও কাজ দেখতে চান। কিন্তু একেবারেই কাজ হচ্ছে না, এমনটাও বলা যায় না।

আমরা সব সময় অন্যকে দোষারোপ করি, নিজেদের কাজটা ঠিকমতো করি না। ঢাকা শহরে জলাধার খুব একটা চোখে পড়ে না, শুধু সারি সারি কংক্রিটের জঞ্জাল।

অনেকেই হয়তো বলবেন প্রভাবশালীরা সব নদী-খাল দখল করে নিয়েছেন। কথাটা মিথ্যা নয়, তবে সাধারণ মানুষ কতটুকু জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন দুটি গাছের জন্য, একটি পুকুরের জন্য? সবাই মিলে কি শহরটাকে নষ্ট করিনি?

২৪ এপ্রিল ২০২৪ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে।

ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রা থাকে ২ ডিগ্রি বেশি।

ঢাকার ময়লা–আবর্জনার ব্যবস্থাপনায় এখনো ভালো কিছু করা যায়নি, পথচারীদের জন্য শীতল জায়গার ব্যবস্থা করা যায়নি, পর্যাপ্ত গণশৌচাগার স্থাপন করা যায়নি, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই, এখানকার বাতাসের দূষণও সর্বোচ্চ।

মোদ্দাকথা হলো, ঢাকার কোনো কিছুই আসলে ঠিক নেই। এমন চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে একজন হিট অফিসারকে দোষ দেওয়া সহজ। কিন্তু এর থেকে উত্তরণের পথ এত সহজ নয়।

সবাই মিলে কাজ করেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। ঢাকার নতুন যে আবাসিক এলাকাগুলো গড়ে উঠছে, সেখানে যদি এখনো গাছপালা ও জলাধারের ব্যবস্থা আমরা করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে। যে শহর আমরা তিলে তিলে ধ্বংস করেছি, তার জন্য একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দোষারোপ না করে চলুন সবাই মিলে ঢাকার প্রকৃত উন্নয়নের জন্য কাজ করি।

  • মেহেদি রাসেল, কবি ও প্রাবন্ধিক
    mehedirasel32@gmail.com