কথা হচ্ছিল রংপুরের পীরগঞ্জের মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে। পেশায় তিনি মূলত খুদে কৃষক ও কৃষিমজুর। গ্রামে কাজ আক্রা হলেই ঢাকায় চলে আসেন, রিকশা চালান। গ্রামে নিজের চার কাঠা জমি আছে। সেই জমিতে সবজির আবাদ করেন।
এ বছর স্থানীয় একজন মহাজনের (চড়া সুদে যাঁরা স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেন) কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আলুর আবাদ করেছিলেন সেলিম। ঋণ শোধ করার তাগিদ থাকায় খেত থেকেই সব আলু বিক্রি করে দেন। সেটা সেই মার্চ মাসের ঘটনা। এখন সেপ্টেম্বর মাস। বলছিলেন, ‘খেত থেকে আলু বিক্রি করলাম ১২ টাকাত। সেই আলুই ঢাকাত কিনি খাই ৫০ টাকাত। দেখছেননি কী কারবার।’
ঢাকায় এলে সেলিম থাকেন মিরপুরে পীরেরবাগ, যে মালিকের রিকশা চালান, তাঁরই গ্যারেজের ওপরে কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো অস্থায়ী দোতলায়। তাঁর মতো আরও প্রায় ২০ জনের মাথা গোঁজার ঠাঁই সেটি। রাতে থাকার জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ শরীরের মাপের জায়গাটুকু। মেসের সবাই-ই উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর বাসিন্দা। ডিম-ব্রয়লার মুরগি- পাঙাশ মাছের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় তাঁদের মেসে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার আলুর ডাল। কিন্তু সেই আলুর দামও এখন লাগামছাড়া।
আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেঁধে দেওয়ার পর কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে অভিযানও চলছে। কিন্তু তাতে দাম কমার খুব একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো অনেক জায়গায় আলু ব্যবসায়ীরা (মূলত মজুতদার) দল বেঁধে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।
অনেক মানুষ যখন মাত্র কয়েক টাকার আধা কেজি পেঁপে না কিনতে পেরে খালি হাতে ফিরছেন, সেই সময় আলু ব্যবসায়ীদের কেউ ২৫ লাখ, কেউ ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা না হওয়ায় আলু বিক্রি বন্ধ রাখছেন। নিজেদের দেশে উৎপাদিত এবং চাহিদার চেয়ে জোগান অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও মানুষ যে পণ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অনেক বড় অপরাধ।
প্রশ্ন হলো, সরকার দাম বেঁধে দিলেই কি জিনিসপত্রের দাম কমে যায়? আলু, পেঁয়াজ, ডিম ছাড়াও সম্প্রতি ভোজ্যতেল, এলপিজিসহ আরও কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাজারের বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো পণ্যই নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে না। বাজার অর্থনীতির সমর্থক অর্থনীতিবিদেরা দাম বেঁধে দেওয়ার ঘোরবিরোধী। তাঁরা মনে করেন, বাজারকে বাজারের মতো চলতে দিতে হবে। পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মোড়ের মুদিদোকানিও দিব্যি কারসাজি করতে পারেন, সেখানে বাজার প্রকৃত অর্থেই খোলাবাজার হয়ে ওঠে। ক্রমে ছোট হয়ে আসা ব্যাগ বগলে করে যে মানুষটা বাজারে যান আর হিসাব কষে সওদাপাতি করে ফিরে আসেন, তাঁরা বোঝেন, কত ধানে কত চাল। বাজারে এখন সবচেয়ে সস্তা সবজি পেঁপে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দেশ টিভির একটি নিউজের ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে, একজন নারী একটু কম দামে পাবেন বলে দাগি ধরা পেঁপে কিনতে গেছেন। আধা কেজির মতো পেঁপের দাম দোকানি চাইছেন ২০ টাকা। কিন্তু তার সম্বল ১৪ টাকা। এই যে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, এই যে অপারগতার যন্ত্রণার নিয়ে ফিরে আসা—এটাও সমাজের বিপুল একটা অংশের বাস্তবতা।
এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা। প্রতি মাসেই প্রকৃত আয় নেই হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আয় বাড়ছে না। বাজারে জিনিসপত্র আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা কেনার সামর্থ্য অনেকে হারিয়ে ফেলছেন। পরিস্থিতিকে খাদের একেবারে কিনারায় নিয়ে ঠেলে ফেলছে, বাজারব্যবস্থার কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী আর তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। আলুর কথায় ধরা যাক। আমাদের সারা বছরের যে চাহিদা, তার চেয়েও অনেক বেশি উৎপাদন হয়েছে এ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টনের বিপরীতে বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। তারপরও সিন্ডিকেট করে আলু বেশি দামে বিক্রি করছে।
সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে যাতে আলু বিক্রি হয়, সে জন্য ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের তৎপরতা নেই যে তা নয়। কিন্তু বাজার তদারকিতে তাদের যে সামর্থ্য, সেটাকে পাথর যুগের অস্ত্র দিয়ে অত্যাধুনিক ড্রোন, মিসাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রচেষ্টার ফলাফল শেষ পর্যন্ত প্রায় শূন্য।
ভোক্তা অধিকারের ফেসবুক পেজে থেকে দেওয়া বগুড়ার একটি কোল্ডস্টোরেজে অভিযানের ভিডিও দেখছিলাম। আলু ব্যবসায়ীরা কীভাবে এক মৌসুমেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হন, তার একটা ছোট নমুনা সেখানে পাওয়া যায়। ভিডিওতে আজিজুল হক কলেজের প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থীকে জেরা করতে দেখা যাচ্ছে। পৈতৃক সূত্রে তার কয়েক বিঘা জমি আছে, যেখানে এ বছর আলু চাষ করেছিলেন। নিজেদের জমিতে আলু উৎপাদিত হয়েছে এক হাজার বস্তার মতো। আর কৃষকদের কাছ থেকে আলু নিয়ে কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন ছয় হাজার বস্তা।
তিনি একজন ছোট ব্যবসায়ী। নিজেদের জমিতে আলু উৎপাদন খরচ হয়েছে কেজিপ্রতি ১১ টাকার মতো। কৃষকের কাছ থেকে কিনেছেন ১২ টাকায়। কোল্ড স্টোরেজে বস্তাপ্রতি রাখার জন্য খরচ ৫ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ যোগ করেও তিনি যদি ২২ টাকা বিক্রি করেন, তাতেও তাঁর লাভ থাকে। কিন্তু বিক্রি করছেন ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা। সেই বিক্রিও করছেন কোনো রসিদ ছাড়া, মুখে মুখে। মানে এই আয় থেকে আয়কর দেওয়ার বালাই নেই। সেই আলু ক্রেতার কাছে যখন যাচ্ছে, দাম হয়ে যাচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, এ বছর আলুর ব্যবসা করে তিনি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাভ করবেন।
২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বগুড়া ও জয়পুরহাটের ৫৬টি হিমাগার বন্ধ করে রেখেছেন আলু ব্যবসায়ীরা। বগুড়ার একজন আলু ব্যবসায়ী অকপটে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘৫ হাজার বস্তা আলুতে ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দরে আলু বিক্রি করলে মুনাফা কম হবে। এ কারণে আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছি।’ শুধু বগুড়া-জয়পুরহাট নয়, আলু উৎপাদনের আরেক কেন্দ্র মুন্সিগঞ্জের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সেখানেও ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে আলু বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অনেক মানুষ যখন মাত্র কয়েক টাকার আধা কেজি পেঁপে না কিনতে পেরে খালি হাতে ফিরছেন, সেই সময় আলু ব্যবসায়ীদের কেউ ২৫ লাখ, কেউ ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা না হওয়ায় আলু বিক্রি বন্ধ রাখছেন। নিজেদের দেশে উৎপাদিত এবং চাহিদার চেয়ে জোগান অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও মানুষ যে পণ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অনেক বড় অপরাধ। কারসাজি ও মজুতদারি করে দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এটাও অনেকটাই শোপিস আইন। কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে প্রয়োগ নেই।
সোজা কথা হলো, বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা হয় না। কারণ, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে যে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট, সেটা অনড় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো গেড়ে বসে আছে। রাজনৈতিকভাবে তারা প্রভাবশালী ও নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী। এদল-সেদল মিলেমিশে সিন্ডিকেট সবার ভাই-বেরাদর। অথচ কৃষকের বেলায় জমি থেকেই কম দামে ফসল বিক্রি করে দেওয়া আর ভোক্তার বেলায় সামান্য কয়েক টাকার জন্য কম কিনে কিংবা খালি হাতে ফেরার বাস্তবতা।
সিন্ডিকেট পেলেপুষে যত্নে লালন-পালন করে জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেওয়া আর আরব্য গল্পের আলিবাবার মতো ‘খুল যা সিম সিম’ দাওয়া মন্ত্র আওড়ানোর মধ্যে পার্থক্য নেই।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী