গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্টের বিকেল থেকেই যে প্রশ্নটি সবার মনে বড় হয়ে উঠেছে, তা হলো ভারত বাংলাদেশের এই অকস্মাৎ পরিবর্তনকে কীভাবে গ্রহণ করবে এবং তার প্রতিক্রিয়া কী হবে।
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় না নিলেও এসব প্রশ্ন উঠত, কিন্তু ভারতে আশ্রয় নেওয়ার এবং ভারত থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার দ্রুত সম্ভাবনা না থাকায় গত তিন দিনে এই প্রশ্ন আরও বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে এবং তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে।
যে সরকারের প্রতি ভারত দেড় দশক ধরে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং একটি স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা ও তাকে অব্যাহত রাখতে অনুঘটকের কাজ করেছে, জনরোষে তার পতনের কারণ ভারতের নীতিনির্ধারকেরা উপলব্ধি করতে পারবেন, এমন আশা করার কারণ ছিল না।
কেননা গত বছরগুলোয় বিশেষত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা এটা সুস্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন যে হাসিনার শাসনের ভিত্তি জনগণের সমর্থন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষক থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকেরা হাসিনাকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছে। সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে।
শুধু ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নয়, ২০১৮ সালেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই ‘অত্যন্ত নিবিড়ভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে’ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ পরবর্তী সংসদে একটি বিব্রতকর সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে’ (পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
এমন বাস্তবতায় ভারত তার বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে তার প্রভাববলয়ে রাখতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মাধ্যমে এক অসম সম্পর্কে বন্দী করেছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু নীতিনির্ধারক নয়, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতে যাঁরা গবেষণা করেন, দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে তঁাদের প্রায় সবারই বাংলাদেশ–সংক্রান্ত ধারণা যতটা না অজ্ঞতাপ্রসূত, তার চেয়ে বেশি জাত্যভিমান দ্বারা পরিচালিত হয়েছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
এটা সবাই জানি যে আন্দোলন দমনে অস্ত্র দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামানো হয়েছিল। সেগুলো এখন কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা ভবিষ্যতে কীভাবে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ভারত সরকার এবং তার নীতিনির্ধারকেরা বিষয়গুলো জানে না, এমন নয়। এ ধরনের কথাবার্তা এবং আচরণ থেকে বোঝা যায় যে ভারত হাসিনা সরকারের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি তার স্বার্থের অনুকূলে রাখতে বিভিন্ন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতীয় সাংবাদিক, গবেষকদের এই ধারণার পেছনে যে প্রত্যাশা কাজ করেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ ও এর নাগরিকদের প্রজন্মান্তরে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ থাকতে হবে এবং সেই কৃতজ্ঞতা কেবল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর নেত্রী শেখ হাসিনাই নিশ্চিত করতে পারেন। এই বিবেচনা দল-নির্বিশেষে ভারতে এতটাই গভীর যে তাঁরা বুঝতে পারেননি, ‘কৃতজ্ঞতা হচ্ছে বহন করার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ক্রুশকাষ্ঠ’।
শেখ হাসিনার পতন তাঁদের নীতির এবং দৃষ্টিভঙ্গির অসারতা প্রমাণ করেছে। কিন্তু এই বাস্তবতা স্বীকার করার পরিবর্তে ভারতীয় নীতিনির্ধারক এবং গণমাধ্যমগুলো যে ধরনের অবস্থা গ্রহণ করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন হতে হয়। বাংলাদেশের এই গণ-অভ্যুত্থানকে ইসলামপন্থীদের উত্থান বলেই বর্ণনা করা হচ্ছে।
কলকাতার বর্তমান পত্রিকার ৬ আগস্টের শিরোনাম, ‘তাণ্ডব জামায়াতপন্থীদের, ইস্তফা দিয়েই ভারতে পাড়ি হাসিনার, সেনার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ’ কেবল একটি সংবাদপত্রের অবস্থান বলে মনে করা যায় না এই কারণে যে গত কয়েক দিনে ভারতের টেলিভিশনের টক শোর আলোচনা থেকে শুরু করে ইউটিউবে প্রচারিত বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানেও একই সুর শোনা যাচ্ছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে যে ধরনের সহিংসতা ঘটছে, সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। কিন্তু ভারতের গণমাধ্যমে যে অতিরঞ্জন হচ্ছে, তা এমনকি পশ্চিম বাংলা পুলিশও মনে করে।
৭ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘কিছু স্থানীয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যেভাবে রিপোর্টিং হচ্ছে, তা খুব দৃষ্টিকটুভাবে সাম্প্রদায়িক এবং ভারতের প্রেস কাউন্সিলের নিয়মাবলির পরিপন্থী।’
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের এই গণজাগরণকে চীন-পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র বলে বর্ণনা করে ৬ আগস্ট প্রতিবেদন ছেপেছে ইন্ডিয়া টুডে। বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানের আলোচকেরাও এ ধরনের কথাই বলে আসছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বাইরের সব শক্তিকে পাকিস্তানি আইএসআইয়ের সমর্থনপুষ্ট বলে বিবেচনা করার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
২১ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় ভাষ্য ছিল, ‘আওয়ামীবিরোধী ক্রমবর্ধমান জন-অসন্তোষ ভারতের জন্য নিরাপত্তা-সংকট তৈরি করছে। সর্বশেষ যা ভারতের প্রয়োজন, তা হলো আওয়ামী-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-সমর্থিত একটি সরকার পরিচালিত বাংলাদেশে নয়াদিল্লির উচিত তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির সব অংশের কাছে পৌঁছানো।’
ভারতের সরকার ও বিরোধী দল বাংলাদেশ প্রশ্নে একই অবস্থানে রয়েছে। লোকসভায় ৬ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের বিবৃতি বা সর্বদলীয় সভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যখন প্রশ্ন করেন যে বাংলাদেশের ঘটনার পেছনে বিদেশি হাত আছে কি না, তখন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলাই যে এর উদ্দেশ্য, তা বোঝা যায়। এ ধরনের আলোচনা পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রভাবিত করার চেষ্টা।
বাংলাদেশে একটি উগ্র গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট সরকার আছে—এমন প্রচারের ফলে অন্য দেশগুলো যদি পর্যবেক্ষণের জন্যও সময় নেয় তা নতুন সরকারের জন্য, বিশেষত অর্থনৈতিক সাহায্য প্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেটা যে বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিতিশীলতার কারণ হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ভারতের এই আচরণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের একটি অংশকে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে উৎসাহী করবে। যে লাখ লাখ দলীয় কর্মী ফেলে হাসিনা পালিয়ে গেছেন, সেই নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিডিও বার্তা—‘সাহস নিয়ে দাঁড়ান, আমরা আছি’ নিশ্চয় শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের আহ্বান নয়।
এটা সবাই জানি যে আন্দোলন দমনে অস্ত্র দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামানো হয়েছিল। সেগুলো এখন কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা ভবিষ্যতে কীভাবে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ভারত সরকার এবং তার নীতিনির্ধারকেরা বিষয়গুলো জানে না, এমন নয়। এ ধরনের কথাবার্তা এবং আচরণ থেকে বোঝা যায় যে ভারত হাসিনা সরকারের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি তার স্বার্থের অনুকূলে রাখতে বিভিন্ন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।
এ অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি। বাংলাদেশ থেকে পলায়নের পর হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাবেন, সেটা মোটেই অভাবিত নয়। কিন্তু বিমানবন্দরে ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের উপস্থিতি এবং তাঁদের মধ্যকার আলোচনা এটাই জানিয়ে দেয় যে ভারত এখনো হাসিনাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির কুশীলব বলেই বিবেচনা করে।
বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান বা গৃহযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে স্বৈরাচারী শাসকদের পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু পলাতক এই ব্যক্তিদের কোনো দেশে সরকারিভাবে বিমানবন্দরে কার্যত ‘অভ্যর্থনা’ জানানোর কোনো উদাহরণ নেই। এই তথ্যই এই পদক্ষেপের গুরুত্ব বোঝায় যে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিকে ভারত আশ্রয় দেয়নি।
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি; ভারত সরকার বলেছে, তারা হাসিনাকে সময় দিচ্ছে সিদ্ধান্ত নিতে। শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করছেন। পশ্চিমা দেশগুলো তাঁকে আশ্রয় দেবে বলে মনে হয় না। বিকল্প হচ্ছে, উপসাগরীয় দেশগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকলে এই দেশগুলো এ বিষয়ে উৎসাহী হবে বলে মনে হয় না। পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ এ ক্ষেত্রে উদাহরণ বলে বিবেচনার অবকাশ নেই।
শেখ হাসিনা কেবল যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তা নয়, তাঁর শাসনের শেষ দিনগুলোয় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বড় কাজ হচ্ছে গত ১৫ বছরে যারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং গুম-খুনের নির্দেশ দিয়েছে, এসব কাজে যুক্ত থেকেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার অনুরোধ করতে পারে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায়ই তা করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশে হাসিনাকে বিচারের চেষ্টা করলে তা অস্থিরতার কারণ হতে পারে এবং একে প্রতিহিংসামূলক বলে মনে হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টম কিন বিবিসির প্রতিবেদককে বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিষয়গুলো তদন্ত করেন এবং কোনো বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়, সেটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করবে। ক্ষমতাচ্যুতির আগেই বাংলাদেশের বাইরে থেকে এ ধরনের একটি নাগরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; এখন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবেই এই প্রক্রিয়া সূচনা করতে পারে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা কি সেটা বিবেচনায় নিচ্ছেন?
আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক