আমরা মোটামুটিভাবে মেনে নিয়েছি এই দেশের এমপিরা তাঁদের মর্জি মাফিক অনেকে কিছুই করতে পারবেন
আমরা মোটামুটিভাবে মেনে নিয়েছি এই দেশের এমপিরা তাঁদের মর্জি মাফিক অনেকে কিছুই করতে পারবেন

এমপির প্লট-ক্ষুধা, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আর ‘আইনের শাসন’

এমপি যাকে-তাকে ধরে পেটাতে পারেন। পেটাতে পারেন একজন কলেজ অধ্যক্ষকেও, পেটানোর পর আবার পাশে রেখে প্রহৃত ব্যক্তিকে দিতে বলাতে পারেন কেউ পেটায়নি তাঁকে। এমপির পথের কাঁটা হলে জামাত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে এমপি নিজ হাতে কিল-ঘুষি মারতে পারেন কলেজশিক্ষকদের।

এমপির মোটর শোভাযাত্রা এলাকায় গেলে কোনো মোটরসাইকেল সরতে দেরি করলে সেই মোটরসাইকেল চালককে পেটাতে পারেন এমপি। নিজ পক্ষের পান দোকানদারের সঙ্গে কারও ঝগড়া হলে এমপি সালিস বসিয়ে অভিযুক্তকে চড় থাপ্পড় মারতে পারেন। কমিটি পছন্দ না হলে একজন এমপি বহু নেতা কর্মীর সামনে পেটাতে পারেন উপজেলা চেয়ারম্যানকে। কথা না শুনলে শিশু কোলে থাকা ব্যক্তিকে গুলি করতে পারেন যাতে শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। নিজের দলের কিংবা বাইরে যে কাউকে পেটানো কিংবা কোপানোর মতো যে কোনো হুমকি দিতে পারেন তাঁরা। এসব করেও ন্যূনতম সমস্যায় পড়তে হয় না তাঁদের।

শুধু এমপি কেন, অসীম ক্ষমতা এমপি পুত্রদেরও। রাস্তায় গাড়ির সঙ্গে মোটরবাইকের সমস্যা হলে বাইক আরোহীকে এমপি-পুত্র পেটাতে পারেন। রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়ে বিরক্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে পারেন। এমপি এবং এমপি-পুত্ররা তো বটেই একজন এমপির আত্মীয় এমনকি পক্ষে থাকা দলীয় লোকজন এলাকার রাজা বনে যান। যে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি এমনকি ব্যক্তিগত প্রকল্প স্থাপিত হতে কিংবা চলতে পারে না, তাঁদের খুশি না করে। অভিযোগ নিশ্চয়ই ঢালাও অভিযোগ নয়, এর ব্যতিক্রম আছে।

আমরা মোটামুটিভাবে মেনে নিয়েছি এই দেশের এমপিরা তাঁদের মর্জি মাফিক অনেকে কিছুই করতে পারবেন। কেউ কেউ বলতে পারেন, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী? বাঁচার জন্য মানিয়ে চলতে শিখতে হয়। এটাই সেই অভিযোজন করার ক্ষমতা যেটা মানুষকে এত দূর নিয়ে এসেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ক্ষেত্রে যা ঘটছে, সেটা ওপরে উল্লেখ করা ঘটনাগুলোর চাইতে একেবারেই আলাদা।

‘আইনের শাসন’ বলে একটা কথা এ দেশের ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আমরা শুনি নিয়মিত। এ দেশের জনগণ জানে এমনকি কাগজে-কলমে একটা ভালো আইনেরও কতটা প্রযুক্ত হবে, কীভাবে প্রযুক্ত হবে সর্বোপরি কার ওপরে প্রযুক্ত হবে, সেটা একান্তই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই শোরগোল তোলা জরুরি, যেনতেন আইন বা বিধি বানিয়ে সেটা চাপিয়ে দিলেই হবে না, সেটা আদতে আমাদের সংবিধানের লিখিত ধারা এবং চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা সেটা যাচাই করা জরুরি।

‘রাজউকের প্লট বরাদ্দ: ক্ষমতাবান স্বামী-স্ত্রীদের প্লট দিতে পাল্টে যাচ্ছে রাজউকের বিধি’-শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত রিপোর্টটি অনেকেই পড়েছেন সম্ভবত। যাঁরা প্রতিবেদনটি পড়েননি, তাঁরা এর কিছু অংশ দেখে নিই: ‘সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী নিজে ঢাকায় রাজউকের একটি প্লট পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুন পেয়েছেন আরেকটি প্লট। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী দুজনের দুটি প্লট নেওয়ার সুযোগ নেই। যেকোনো একটি প্লট ছাড়তে হবে এই দম্পতিকে। কিন্তু উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী কোনো প্লটই ছাড়তে চান না।

অভিযোগ উঠেছে, রাজউক এখন এ-সংক্রান্ত বিধিমালাই বদলে ফেলছে। সংস্থাটির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিধিমালার নতুন খসড়ায় স্বামী-স্ত্রীর নামে পৃথক দুটি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। খসড়াটি অনুমোদন পেলে সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের পাশাপাশি অন্য প্রভাবশালী দম্পতিরাও এই সুবিধা নিতে পারবেন।

এর আগে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধে বিলম্বজনিত জরিমানা মওকুফ এবং তুলনামূলক ছোট প্লট পাল্টে বড় প্লট নেওয়ার সুবিধা দিয়েছে রাজউক।

জনাব মুক্তাদির এবং অন্যান্য ক্ষমতাশালীদের জন্য আইনি পথেই অন্যায়, অনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবশ্যই সেটা নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীন দলের অনুগত সহযোগী-সমর্থকদের( অলিগার্ক) হাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নামের এক ‘আলাদিনের প্রদীপ’ তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব করা হয়েছে মোটা দাগে আইনি পথেই। টেন্ডারসহ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এর সকল বিধান পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে দেওয়ার জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামের এক আইন করে, যা এই সেক্টরের ইনডেমনিটি আইন বলেই পরিচিত আমাদের কাছে। এই আইনের কারণে এই খাতে এরপর কী কী হয়েছে, সেটা জানি আমরা সবাই, তাই সেই আলোচনা এখানে আর বাড়াচ্ছি না।

বাংলাদেশ যে আজ আর্থিক সংকটে পড়েছে সেই প্রেক্ষাপটে জ্বালানি খাত নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এটাও আলোচনায় রাখতেই হবে, এ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিটি একেবারে ভেস্তে দেওয়ার জন্য অন্যতম প্রধান দায়ী ব্যাংক খাতে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের লুটপাট। এই লুটপাট নিশ্চিত করার জন্য নানা আইন এবং বিধি পরিবর্তনের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে ক্ষমতাসীন সরকারের।

বর্তমান সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হলমার্ক কেলেঙ্কারি দিয়ে শুরু করে একের পর এক ব্যাংক লুট হয়েছে। ফলশ্রুতিতে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে তরতর করে। খেলাপি ঋণের বড় অঙ্ক একদিকে সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে তো বটেই, কিন্তু এতে আছে আরও অনেক বড় সমস্যা-সরকারের অলিগার্কদের পক্ষে নতুন ঋণ পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই এসেছে একের পর এক অকল্পনীয় নিয়ম/বিধি যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমেছে, আর খেলাপির তালিকা থেকে বের হয়ে খেলাপিরা বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নতুন নতুন লোন নেওয়ায়।

২০১৯ সালের মে মাসে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট করার মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে নীতিমালা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই তুচ্ছ পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে অনেকেই ঋণ পুনঃতফসিল করায় সেই সময়ের প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বছর শেষে নেমে আসে এক লাখ কোটি টাকার নিচে।

আমরা জানি এরপর করোনার অজুহাতে সরকার দফায় দফায় নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে অনেক বড় বড় ঋণের খেলাপিদের। এরপরও এই বছরের জুন মাসের শেষে দেখা যাচ্ছে খেলাপি আবার সোয়া এক লাখ কোটি টাকার বেশি হয়েছে।

নীতিমালা পরিবর্তন করে ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দেওয়া যে ক্ষমতাসীনদের নীতিরই অংশ, এই ধারা যে পাল্টাবে না, সেটা নজির দেখা গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর দায়িত্ব নেবার পরও। নতুন গভর্নর বরং ছড়িয়ে গেছেন তাঁর পূর্বসূরিকে। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে যোগদান করার পঞ্চম কার্যদিবসের দিন খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি এসব ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। এই সুযোগে যাঁরা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করবেন তাঁরা আবার নতুন করে ঋণ পাবেন।

সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখানো হচ্ছিল ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা তখন আইএমএফ আমাদের জানিয়েছিল তখনই খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, খেলাপি ঋণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাজ করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের হিসাবে তখনই খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকার বেশি ছিল। অবলোপন করা ঋণ, আদালতের স্থগিতাদেশ, এবং বিশেষ সুবিধা নিয়ে পুনঃতফসিল করা ঋণ মিলিয়ে তিনি সেই অঙ্ক আমাদের সামনে এনে বলেছিলেন, এসব ঋণ ফেরত আসবে না। এখন এই পরিমাণ কত হতে হতে পারে সেটা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়।

এই দেশে এমপি, মন্ত্রী, সরকারি দলের ক্ষমতাশালী নেতা কিংবা সরকারি আমলাদের অনেকেই আইন এবং সংবিধান বহির্ভূত নানা সুযোগ-সুবিধা নেন, এমনকি অন্যায় কাজ করেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রে সরকারকে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এমনকি অন্যায়ের শিকার ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার ঘটনাও নেই প্রায়। কোনো সুযোগ-সুবিধা আইন/বিধি বহির্ভূতভাবে নেওয়া হলেও এই ‘চোরের মায়ের বড় গলা’র দেশে সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তি গলার স্বর নিচু রাখেন না, জানি। কিন্তু তবুও বিষয়টি অন্যায়, অনৈতিক থেকেই যায়। কোনো এক সময় সেসব অন্যায় অনিয়মের শাস্তির সম্ভাবনা অন্তত থাকে।

‘আইনের শাসন’ বলে একটা কথা এ দেশের ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আমরা শুনি নিয়মিত। এ দেশের জনগণ জানে এমনকি কাগজে-কলমে একটা ভালো আইনেরও কতটা প্রযুক্ত হবে, কীভাবে প্রযুক্ত হবে সর্বোপরি কার ওপরে প্রযুক্ত হবে, সেটা একান্তই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই শোরগোল তোলা জরুরি, যেনতেন আইন বা বিধি বানিয়ে সেটা চাপিয়ে দিলেই হবে না, সেটা আদতে আমাদের সংবিধানের লিখিত ধারা এবং চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা সেটা যাচাই করা জরুরি। এটা করেছি বলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি ন্যায্য আইন বলে স্বীকারই করি না আমরা, তাই এর মাধ্যমে যাচ্ছেতাই করাকে বলতে পারি না 'আইনের শাসন'।

কলামের শুরুর দিকে আমাদের সবকিছু মেনে নেওয়ার কথা বলছিলাম। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের নির্বিকার থাকা দেশের বাকি সবকিছু তুলে দেবে অলিগার্কদের হাতে এবং সেটা মোটাদাগে আইনি পথেই। জনাব উবায়দুল মুক্তাদির এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষমতাশালীদের প্লট পাওয়ার জন্য বিধি পরিবর্তন করার চেষ্টা মোটেও তুচ্ছ বিষয় নয়, এটা এক ভীতিকর নজির।

  • ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক