আম্বানিদের ছেলে অনন্ত আম্বানি ও মার্চেন্টদের মেয়ে রাধিকা মার্চেন্টের বিবাহপূর্ব উৎসব নানা দিক থেকেই অভিনব ও অভূতপূর্ব। এই উৎসব শুধু চোখ ধাঁধিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি। ভারতের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি যে বদলে যাচ্ছে, তারও ইঙ্গিত দিয়েছে।
পরিকল্পনা করে অনুষ্ঠানের নির্বাচিত অংশের ভিডিও প্রকাশ এবং এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আবহ সৃষ্টির যে চেষ্টা হবে, সেটা অনুমিতই ছিল। ঐশ্বর্য, শৌর্য-বীর্য, পারিবারিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিগত সংগ্রাম থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি—এই সবকিছুর অপূর্ব মিশেলের দারুণ এক প্রদর্শনী হয়ে গেল যেন। এই পাণ্ডুলিপি সুরাজ বারজাতিয়ার নির্দেশিত সিনেমাকেও হার মানায়।
বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় মনে করেন এ ধরনের প্রদর্শনে অনেকের মনে হিংসার উদ্রেক হয়। এ কথা সব সময় সত্য নয়। হিংসার উদ্রেক হয় তখনই, যখন প্রতিযোগিতা থাকে। বিত্তবৈভবের দিক থেকে আম্বানিদের ধারেকাছে কেউ নেই।
যদিও বৈষম্যের ভারতে এমন জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী বাস্তবতা থেকে দৃষ্টি সরানোর উৎকট চেষ্টা। অনেকে এ কথা বলে সান্ত্বনা খোঁজেন এই ভেবে যে পরের ধন দেখে যাদের চোখ টাটায়, আখেরে তাদের ভালো হয় না।
অ্যাডাম স্মিথ এই অনুভূতির একটা নাম দিয়েছেন। তিনি এই বোধকে বলছেন, ধনীদের প্রতি অদ্ভুত সহানুভূতির বোধ। কারণ, ধনীরাই মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি; সুখ বলতে কী বোঝায়, তার প্রতিভূ ধনীরাই।
যদি তাঁরা সুখ ভোগ করতে না পারেন, তাহলে মানুষের চেয়ে কম মর্যাদাকর জীবনযাপন যাঁরা করেন, তাঁদের আর আশা থাকে না। সে কারণে ধনীদের প্রতি আমজনতার একটা অদ্ভুত মোহ কাজ করে। ধনীদের অভিলাষ, আকাঙ্ক্ষা—সবকিছুর প্রতিই তাদের সহানুভূতি থাকে, তাদের সাফল্যে মনে হিংসা জন্মায় না।
এরপরও এই উৎসব অন্য উৎসবের চেয়ে কিছুটা আলাদা। ঐতিহ্যগতভাবে ধনীরা তাঁদের ইচ্ছেমাফিক জিনিস প্রকাশ করে থাকেন। কেউ দেখান শানশওকত, কেউ শিল্প আবার কেউ ক্ষমতা। আম্বানিপুত্রের বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠান ছিল এই সবকিছুর মিশেলে। ফলে এই অনুষ্ঠান নিয়ে তৈরি হয়েছিল ব্যাপক আগ্রহ।
দ্বিতীয় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছিল, তা হলো ভারতীয় সংস্কৃতিতে আগে যা দেখা যায়নি, তাকে মেলে ধরা। বৃহত্তম সিনেমা নির্মাতারা নিজেরাই সিনেমার উপজীব্য হয়েছেন, যাঁরা বিনোদনজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা বিনোদনের অংশ হয়ে গেছেন এবং সংবাদের মালিকেরা সংবাদ হয়েছেন।
সন্দেহ নেই আম্বানিরা মনোমুগ্ধকর, দারুণ ও বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ। সন্দেহ নেই, যাঁরা আম্বানি পরিবারের বিয়েতে হাজির হয়েছেন, তাঁরা সত্যিই আম্বানিদের ভালোবাসেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে কারও মনে হতে পারে টাকার গরম থাকলেই তা প্রদর্শনযোগ্য, যাকে খুশি তাকে দিয়ে নাচানো যায়।
সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তনও এমন প্রদর্শনের পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি যদি নিজের পরিচয় প্রদর্শন না করেন, তাহলে অস্তিত্বই সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। আমাদের পরিচয়ের অত্যন্ত ব্যক্তিগত দিকও আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরি, ভোটে তুলি।
বন্ধুরা একে অন্যের সম্পর্কে কী ভাবছে, অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁদের হবু পুত্রবধূ নিয়ে, ভালোবাসা বা ঘৃণা—এই সবকিছুই তুলে দেওয়া হচ্ছে স্বল্প পরিচিত আমজনতার কাছে। তাঁরাও এই বিষয় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে এসব প্রতিক্রিয়ার আত্মিক যোগ সামান্য।
মানবহিতৈষী কাজ, ভক্তি, নিষ্ঠা, সমানুভূতি, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, পারিবারিক বন্ধনের বেলায় এত ঢাকঢোল পেটানো অনাবশ্যক। কিন্তু দেখনদারিটাই যখন মূল, মানুষ তখন ব্যস্ত থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার কী ‘পারফরম্যান্স’ তা নিয়ে।
অনেক সময়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ যা প্রদর্শন করে, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সব সময় নিজেকে আদর্শ হিসেবে, প্রকৃত মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা থাকে: দেখো, এই হলাম আমি। আম্বানিদের বিয়ের পাণ্ডুলিপি সুচারুভাবে আমাদের এই সময়টাকেই ধরেছে।
কিন্তু এ ঘটনার একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। অ্যাডাম স্মিথ যেমনটি বলেছিলেন, হিংসা কোনো কার্যকর অনুভূতি নয়। বরং তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন ধনীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে।
কারণ, ধনীরা তাদের ভোগবিলাস নিয়ে ঠিক যতটা প্রকাশ্য, ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে ঠিক ততটাই লুকোছাপা করে থাকেন। সম্পদ কখনো অন্যান্য ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে না এমন একটা ভ্রান্ত ধারণাও আবার সমাজে বিদ্যমান।
দেখুন, যেকোনো বিবেচনায় ভারত একটা উৎকট ধনতান্ত্রিক দেশ। এই দেশ ধনীরা শাসন করে। কিন্তু যে বিষয়টি চমকিত করে, তা হলো এ নিয়ে এখন আর লুকোছাপা নেই। বরং এই ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এখন উদ্যাপন করা হয়।
এই অনুষ্ঠানের চিত্তাকর্ষক দিক হলো এখানে ভোগবিলাস যেমন প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হয়েছে, একইভাবে প্রদর্শিত হয়েছে ক্ষমতাও।
ক্ষমতা কবে থেকে প্রদর্শনের বিষয় হলো? তিনটি বিষয় মনে এল। কথায় বলে, টাকা যার ক্ষমতা তার। শুধু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নয়, বড় পুঁজির ক্ষমতা নিয়ে নানান কল্পকথা চালু আছে।
যেমন বলা হয়ে থাকে, আম্বানি (বা আদানিরা) যা করতে পারে, তা করার সাধ্য আর কারও নেই। যদি আপনি বড় শোধনাগার, দ্রুত লাভ উঠে আসবে এমন বন্দর, সস্তায় টেলিকম বা বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়ন হতে চান, আপনার জন্য একমাত্র বাধা হলো বড় পুঁজি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারসাজির কথা আর না–ই বা বললাম।
এই কারসাজিই তো সব সম্ভব করছে। এর মহিমা দেখুন। একদিক থেকে আম্বানিরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা কী পারে, কতটা পারে। দ্বিতীয়ত, আম্বানিদের এই অনুষ্ঠানে গোটা বিশ্বকে জানান দেওয়ার ব্যাপার ছিল। কে না এসেছিলেন, ‘কাতারের আমির থেকে রিয়ানা পর্যন্ত?’ খারাপভাবে বলতে গেলে, বিশ্ব ভারতের সামনে নুয়ে পড়েছে এমন একটা ভাব। ভারত ধনী না-ই বা হলো, ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির বাস।
এক নম্বর হওয়া মানে বিরাট কিছু, এমনটাই বোঝানো হলো এই অনুষ্ঠানে। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই দেখানো হলো ভারতের ক্ষমতা কত। তৃতীয় আরেকটি দিক হলো ভারতীয় পুঁজির সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যোগ।
এই পুঁজি একটি জাতীয়তাবাদী বিষয়, আর পুঁজির প্রদর্শন ঘটিয়েছে শতভাগ পুঁজিবাদী ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ একটি পরিবার। সব মিলে বিবাহপূর্ব এই অনুষ্ঠান একটা পাক্কা জাতীয়তাবাদী মুহূর্তের অবতারণা করেছিল।
সন্দেহ নেই আম্বানিরা মনোমুগ্ধকর, দারুণ ও বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ। সন্দেহ নেই, যাঁরা আম্বানি পরিবারের বিয়েতে হাজির হয়েছেন, তাঁরা সত্যিই আম্বানিদের ভালোবাসেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে কারও মনে হতে পারে টাকার গরম থাকলেই তা প্রদর্শনযোগ্য, যাকে খুশি তাকে দিয়ে নাচানো যায়।
আপনি একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারেন বা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা, আম্বানিরা ডাক পাঠালেই আপনাকে ছুটে আসতে হবে। এ থেকে বোঝা যায়, কেন মানুষ ক্ষমতাকে এত ভালোবাসে।
অথবা রাজনীতিতে, আপনি হয়তো নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করেন। কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি আপনাকে এক সেকেন্ডের মধ্যে উধাও করে দিতে পারে। তাই একজন বিরাট নেতা অন্যদের কেটেছেঁটে ফেললেও আমরা খুশি।
আমরা একক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এই একটা বিষয়ে চমৎকার সমতা আছে আমাদের। আমরা সবাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাই। হোক তা রাষ্ট্রীয় কিংবা পুঁজির। নিজেদের সম্পর্কে যে সত্য আমরা প্রকাশ করতে চাই না, সেই সত্যই আম্বানিপুত্রের বিয়েতে বেরিয়ে এল।
প্রতাপ ভানু মেহতা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রদায়ক সম্পাদক
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত