আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনীতিকে একটা বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে গেছে—সে কথা নতুন নয়। গত দুই বছরের পত্রিকা বা টিভি মিডিয়ায় অর্থনীতিবিদদের অজস্র লেখা বা সাক্ষাৎকার থেকে তা দেখা যায়। ব্যবসায়ীদের মতো অর্থনীতিবিদেরা ভোল পাল্টান না।
অনমনীয় মূল্যস্ফীতি, ডলার–সংকট, রিজার্ভের ভীতিকর ক্ষয়, লাগামহীন খেলাপি, রাজস্বের ক্রমবর্ধমান আনুপাতিক দুর্বলতা, প্রকট বেকারত্ব, নিয়ন্ত্রণের নামে পুঁজিপণ্যের আমদানির ব্যাপক হ্রাস, সরকারের প্রশ্রয়ে ধনিকগোষ্ঠীর মুদ্রা পাচার, ব্যাংকে তারল্য–সংকট, পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সরকারের বেহিসাবি ঋণবৃদ্ধি, নীতিহীনতার বাজেট—এই সব কথাই অর্থনীতিবিদেরা উল্লেখ করে শেষতক কখনো ব্যঙ্গবিদ্রূপ কিংবা কখনো ধমকের শিকার হয়েছেন।
কাঙালের কথা বাসি হলে ফলেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে অগৌরবজনক পথে বিদায় নিতে হয়েছে। আর কোনো রাজনৈতিক দল যদি এভাবে বিদায় নিতে না চায়, তাহলে রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ক্ষমতার জন্য অস্থির হলে চলবে না।
অর্থনৈতিক উৎকণ্ঠাগুলো অবজ্ঞার শিকার হয়েছিল দুই কারণে। এক. প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্যের উষ্ণতা মেপে পদায়ন করা হতো। প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের অধিকাংশই ছিলেন অযোগ্য কিন্তু লবিসম্রাট। বিশেষ ব্যক্তিদের আশীর্বাদ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুঁজিবাজার, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ কোনো অর্থ খাতের নেতৃত্ব ঠিক করা হতো না। সেই কর্তারা অভ্যন্তরীণ ক্ষতের চিত্র লুকিয়ে রাখতেন, যাতে লুটেরারা সুখী থাকেন।
দুই. রাজনীতিকেরা বুঝতেন যে অর্থনীতিকেরা ঠিক কথাই বলছেন। কিন্তু তাঁদের কথায় কর্ণপাত করতে গেলে মাত্র পাঁচ বছরে ১২০ গুণ সম্পদ বৃদ্ধির ‘মহান ব্রত’ পূরণে বিঘ্ন হতে পারে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কোনোভাবেই সম্ভব নয়; কারণ দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিই দিয়ে রেখেছে আমাদের সংসদ।
সম্পদ বৃদ্ধিতে যিনি যত এগিয়ে ছিলেন, তিনি তত তাড়াতাড়ি এমপি টিকিটের সবুজসংকেত পেয়েছেন। এটি কি মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিবমিষা সৃষ্টি করে না? একজন প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন যে তাঁর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক—তখন মানুষের ক্ষোভ সেই পিয়নের ওপর জন্মায় না। তা জন্মায় ওই পিয়নের মালিকের ওপর। একজন মন্ত্রীর বউ টিউশনি করে ঢাকায় ১৮টি ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যান।
শুনে আমেরিকার চাকরি ছেড়ে আবার ছাত্রজীবনের গৃহশিক্ষকতায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। কেউ বলবেন, একটি সরকারের পতন হলে তাদের নামে নানা কুৎসা রটানো হয়। গত দেড় বছরের ঘটনা তা বলে না। সংবাদমাধ্যমগুলো সাহস করে একের পর এক দুর্নীতির ‘বীরগাথা’ তুলে ধরেছে এবং চাপের মুখে পড়েছে।
যথা পূর্বং তথা পরং হলে একদিকে এতগুলো আত্মত্যাগের প্রতি অমর্যাদা করা হবে, অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে এই দেশ আফ্রিকার সুদান, চাদ, সোমালিয়া বা ইথিওপিয়ার পথে পা বাড়াবে। বাংলাদেশের ব্যাংকদস্যু বা ভূমিদস্যুদের চেয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে উন্নততর। কারণ, তারা অন্যের জিনিস লুটে দেশে আনে। আমাদের দস্যুরা দেশকে ফোকলা করে সম্পদ বিদেশে নেয়।
বিভিন্ন বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ‘প্রধানগণের’ নানা চৌর্যবৃত্তির উপাখ্যান একের পর এক বের হওয়া শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের এক ‘ক্ল্যাসিক্যাল ছাগল’ এক রাজস্ব লুটেরার সম্পদ-বিস্ফোরণ ফাঁস করে দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও এই কাহিনিগুলো বের হতোই। কারণ, সহমর্মিতার প্রেমে এক চোর আরেক চোরকে ধরিয়ে দেওয়া শুরু করেছিলমাত্র।
গাড়িচালক প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীও এলাকায় এমপি হতে চায়। কারণ, সে জানে অনেক এমপির চরিত্র তার চেয়ে উন্নততর নয়। স্বঘোষিত ‘বঙ্গবন্ধু সৈনিক’ এক শুদ্ধাচারী পুলিশপ্রধান বঙ্গবন্ধুর কোন আদর্শ থেকে সংখ্যালঘুদের জমিজমা দখল করল—বোঝা গেল না।
আর কিছুদিন এভাবে চললে সারা পৃথিবীর ধনকুবেরেরা ছুটে যেতেন বাংলাদেশে, যেখানে সরকারের প্রশ্রয়ে দ্রুততম পথে ধনী হওয়া যায়। এমনকি সম্পদ পাচারের অভিযোগের বিরুদ্ধে আদালত থেকে রায় বাগিয়ে আনা যায়। এখানে কোনো ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন নেই।
সব মিলিয়ে কলুষিত রাজনীতির খপ্পরে থাকা যে অর্থনীতি আমরা পেয়েছি, তা ভঙ্গুরপ্রায়। অর্থনীতির উদ্ধারে রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের পক্ষেই সংস্কারগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব।
কারণ, উপদেষ্টাদের কারও দ্রুত সম্পদ বাড়ানোর ধান্দা নেই। সংসদের বৃদ্ধাতিবৃদ্ধ এমপিদের মতো নেই আমৃত্যু ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র বাসনা। কোনো রাজনৈতিক দল উপদেষ্টামণ্ডলীকে ক্ষমতায় বসায়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব যে হতো না—সেটিও প্রমাণিত।
এই পরিবর্তনের নায়ক যুক্তিবোধে উদ্বুদ্ধ সাধারণ ছাত্রসমাজ, যারা এখনো রাজপথ ছাড়েনি। তাই দুর্নীতি ও বৈষম্যবিরোধী সংস্কারগুলো এই নেতৃত্বই সাধন করতে সক্ষম। কারণ, এদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি নেই।
এই সংস্কারকর্ম একটি স্বগতিপ্রাপ্ত পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে ধৈর্য ধরতে হবে। দ্রুত নির্বাচন দিলে হয়তো একটি বড় দল বা কোনো কোয়ালিশন ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুদ্ধ না করলে অর্থনীতি এক দল দরবেশের হাত থেকে আরেক দল আউলিয়ার হাতে পড়বে।
যথা পূর্বং তথা পরং হলে একদিকে এতগুলো আত্মত্যাগের প্রতি অমর্যাদা করা হবে, অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে এই দেশ আফ্রিকার সুদান, চাদ, সোমালিয়া বা ইথিওপিয়ার পথে পা বাড়াবে। বাংলাদেশের ব্যাংকদস্যু বা ভূমিদস্যুদের চেয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে উন্নততর। কারণ, তারা অন্যের জিনিস লুটে দেশে আনে। আমাদের দস্যুরা দেশকে ফোকলা করে সম্পদ বিদেশে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আসে ১৭৭৬ সালে। প্রথম ১০টি সংশোধনী নিয়ে ১৭৯১ সালে পূর্ণতা পায় ‘বিল অব রাইটস’, যা ওই দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল। এই রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভূমির ওপর দাঁড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, যা দেশটিকে পৃথিবীর প্রধান অর্থনীতির সম্মান এনে দিয়েছে। বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকেও এর অবস্থান প্রথম স্থানে।
এই দৃষ্টান্ত মনে করিয়ে দেয় যে রাজনৈতিক সংস্কারসাধন করতে যথেষ্ট সময় লাগে। কিন্তু ওই ১৫ বছর আমেরিকার বাকি ১৫০০ বছরের পথ নিশ্চিত করে দিয়েছে। তারা ক্ষমতায় ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’ শুরুতেই এনেছে বলে সেখানে কোনো প্রেসিডেন্ট এককভাবে ক্ষমতাশালী হতে পারেননি।
কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা বাঁধা রয়েছে। শেষ ইচ্ছার মালিক বিচার বিভাগ। প্রত্যেক কংগ্রেসম্যান নিজের বিবেক–বিবেচনা থেকে বিতর্ক করে থাকেন। বাংলাদেশের সংসদ ভুলে গেছে বিতর্ক কাকে বলে। সেখানে অপতথ্যের মন্ত্রী অর্থমন্ত্রী সাজেন।
লেখার শুরুতে যেসব অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলা হয়েছে, এর প্রতিটির জবাবে সেই ‘অর্ধতথ্যমন্ত্রী’ সংসদে জুনের শুরুতে জানালেন যে বাংলাদেশ বেশ ভালো আছে। কিছু লোক অপপ্রচার চালাচ্ছে। মুগ্ধ হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। শত সংসদ সদস্য দিবানিদ্রা তাড়াতে টেবিল চাপড়ালেন। পাঁচ বছর কোনো কথা না বলে শুধু টেবিল চাপড়িয়ে সময় পার করা কিসিমের সংসদ সদস্যরা যেন আর নির্বাচিত না হন, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সংস্কার জরুরি। ভণ্ড বিতাড়ন আবশ্যক।
বাজেটকে বার্ষিক পঞ্জিকার সঙ্গে সমন্বিত করার এই তো সময়। এতে হিসাব সহজ হয় এবং বছরের শুরু ও শেষে ঋতুগত কারণে কর্মতৎপরতা বাড়ে। এডিপির বাস্তবায়ন সহজ হয়। নির্বাচন চার বছর অন্তর হলে লুণ্ঠনপাগল এমপিরাও খুব জুত করে উঠতে পারেন না। থাকা উচিত নির্বাচনের এক নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার। বিচার বিভাগ ও সুশীল সমাজের পরিচালনায় চার বছর অন্তর নির্বাচনী সরকার ছাড়া দেশে যে সুস্থ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত। লঙ্কায় গেলে সবাই রাক্ষস হয়। এর প্রতিরোধে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’ রাখতে হবে।
আজ আওয়ামী লীগের দুরবস্থার কারণ এর স্ববিরোধিতা। তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে লড়ে শেষে সেই পদ্ধতির প্রয়াণসাধন মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। একবার কোটার বিরোধিতা করে চার বছর পর আবার এর পক্ষে বাস্তবতাবিমুখ যুক্তি উত্থাপন এই দলটির জন্য হয়েছে আত্মঘাতী। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাস নিয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এক পার্টি শেষকালে শুধু গোয়েন্দা আর মার্কামারা অর্থদস্যুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এটি এই দলের নীতিগত বিচ্যুতি।
অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের ব্যাপারে কড়াকড়ি সংস্কার না আনলে এই সংসদ শেষ পর্যন্ত লুটেরা ব্যবসায়ীদের স্বপ্নপূরণ ক্লাবে পরিণত হবে। কোনো নির্বাচিত সরকার এই সংস্কারগুলো আনবে না। আনতে পারবে না। আনতে পারবে এই সরকারই। তাই সময় দিতে হবে কমবেশি দুই বছর, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে করবে সুস্থ, সবল ও উন্নততর।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক