নতুন একটি বিশ্বায়ন কি আসন্ন

দাভোসের সর্বশেষ সম্মেলন বেশ আশাবহ ছিল
ছবি: এএফপি

বিশ্বায়ন কি স্বরূপে ফিরে আসছে? দাভোসে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে এটিই ছিল বড় প্রশ্ন। সেখানে ডব্লিউইএফের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের জিজ্ঞাসা ছিল, এই বিভক্তির সময়ে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্ভব কি না। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধস, ব্রেক্সিট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন, বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক শক্তির পিছু হটা, কোভিড–১৯ মহামারি এবং সর্বশেষ ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে এক দশক ধরে বিশ্ব বাণিজ্য ও কসমোপলিটানিজমের অবতার হিসেবে কাজ করে যাওয়া ‘দাভোস ম্যান’খ্যাত ডব্লিউইএফের নিরবচ্ছিন্ন ‘মৃত্যু’ হচ্ছে।

কিন্তু এই বছরের সম্মেলনের মেজাজ বেশ আশাবহ ছিল। সামরিক সংঘাত এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে অনেক উদ্বেগ থাকার পরও গত মে মাসে বৈঠকে মিলিত হয়ে বৈশ্বিক অভিজাতরা যতটা ভালো করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, বিশ্ব অর্থনীতি তার চেয়ে ভালো করেছে বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেনীয়রা বীরত্বের সঙ্গে রুশ হামলাকারীদের মোকাবিলা করছেন; পশ্চিমারা ভেদাভেদ ভুলে এক হয়েছে; অনেক আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ইউরোপ এই শীতে ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছে; কেউ কেউ মনে করছেন, এখন পর্যন্ত আমরা মন্দা এড়াতে পারছি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যতটা খারাপের দিকে যাবে বলে ভাবা হয়েছিল, ততটা খারাপ হয়নি। 

তদুপরি এ গুরুত্বপূর্ণ স্বল্পমেয়াদি অগ্রগতির আড়ালে বিশ্বায়ন নতুন রূপ নিয়ে গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অবশ্য তার সেই আদল আগের আদলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আপাতত পণ্যের বিশ্বায়ন শিখরে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। নানা ধরনের পরিষেবারও অধিকতর বিশ্বায়ন হয়েছে। আর এ পরিবর্তনের পেছনে মহামারি চলাকালে ‘টেলিওয়ার্ক-বিপ্লব’ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। 

জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও আংশিক বিপ্লব ঘটে গেছে, যার পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের ভূমিকা আছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ব্যাপক মাত্রায় নবায়নযোগ্য এবং হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ হবে। একই সময়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। পাশাপাশি মাইক্রোচিপ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বেকারত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন দুর্বৃত্ত রোবট নিয়ে সৃষ্ট আশঙ্কা মানুষের মনে নতুন করে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে।

মনে করা হচ্ছে টেলিওয়ার্ক, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং এআই—এ তিন বিষয় দেশগুলোকে পরস্পর নির্ভরতার নতুন নেটওয়ার্কে একত্র করবে এবং তাদের এক হয়ে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে। ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ‘কোনো অঞ্চলই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি অবস্থানেও আসতে পারেনি।’ সুতরাং নতুন একটি বিশ্বায়ন আসন্ন। তবে দাভোসে পুনর্বিশ্বায়নের যে ঝিলিক দেখা গেছে, তা পূর্ববর্তী বিশ্বায়নের ধরন থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। প্রথমত, পুরোনো মডেলটির ভিত্তি ছিল করপোরেট মুনাফা। আর নতুন মডেলটির সমস্ত মাত্রা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে আবর্তিত। 

পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের যুদ্ধকে রাশিয়ার (এবং বর্ধিতভাবে চীনেরও) একতরফা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে উদার এবং নিয়মভিত্তিক আদেশের লড়াই হিসেবে চিত্রিত করেছে। তারা রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দাভোসে কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ছিলেন অনেক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন একজন, যিনি ‘বন্ধুতার’ প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

কিন্তু পশ্চিমের বাইরের অনেকেই মনে করেন, বিশ্ব ব্যবস্থাকে ব্যাহত করা এবং তাদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটানোর ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের মতো ইউরোপ ও আমেরিকাও সমানভাবে দোষী। তারা এ যুদ্ধকে যেভাবে দেখছে তা হলো: কোটি কোটি মানুষের ধ্বংসাত্মক পরিণতির কথা জেনেও পশ্চিমারা এ যুদ্ধকে অর্থনৈতিক সংঘাতে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

দাভোসের পক্ষ থেকে ডলারভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাকে একটি বিশ্বজনীন মঙ্গলময় ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়েছিল এবং এটি বিশ্বের প্রতিটি কোণে সমৃদ্ধি ছড়িয়ে দেবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন এটিকে ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ছলনা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার মাধ্যমে আমেরিকা তার আদর্শিক এবং কৌশলগত নীতি প্রয়োগ করতে পারে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেটাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বিস্তারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত পশ্চিমা নীতিগুলো একই ধরন অনুসরণ করে। 

২০১৪ সালে ফরাসি ব্যাংক বিএনপি পারিবাসকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য ৮০০ কোটি ডলারের বেশি জরিমানা করা হয়েছিল। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সবাই অবগত। এটিকে বৈশ্বিক নিয়মের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এখন আইনকানুনের বৈশ্বিক কাঠামোকে ব্যবহার করে অনেক দেশ অপরাজনীতি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমদানির ওপর একটি নতুন কার্বন শুল্ক আরোপের বিবেচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়েছে। 

তবে ব্যক্তিগত আলোচনায়, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকার নেতারা অভিযোগ করেন, তাদের দেশগুলো ইতিমধ্যে প্রথম শীতল যুদ্ধের সময় সার্বভৌমত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তাদের জন্য আবারও পক্ষ বাছাই করা থেকে লাভের কিছু নেই। ফলে তারা বিশ্বায়নের পক্ষেই থাকবে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মার্ক লিওনার্ড ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও লেখক। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক