মতামত

যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এত ভয় কিসের!

প্রতীকী ছবি

রাজধানীতে আমি যে এলাকায় বড় হয়েছি, সেখানে রাতে চলাফেরা করতে আমার কখনো ভয় লাগেনি। মনে হতো, ‘আমার এলাকা’। জরুরি অবস্থার সময়ে, রাতে ‘আমার এলাকা’র জনমানবশূন্য সুনসান গলি দিয়ে হেঁটে বাসায় যেতেও ভয় লাগেনি।

কর্মক্ষেত্রে দেখি, একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সহকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের টান থাকে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়লে সেই টান আরও শক্তপোক্ত হয়। একজন শিক্ষার্থী তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপদ বোধ করার কথা। নিজ এলাকা হিসেবে সেখানে নিজেকে ক্ষমতায়িত মনে করার কথা। অথচ ঘটছে উল্টো।

গত রোববার রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর ভাষ্যমতে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরপোশাক ও কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পাঁচ তরুণ ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। পরে মুঠোফোন ও মানিব্যাগ রেখে দুজনকে ছেড়ে দেন ওই তরুণেরা। গত বুধবার বেলা তিনটায় হাটহাজারী থানায় নিপীড়নের শিকার ওই ছাত্রী বাদী হয়ে মামলা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ১০ ধারায় ওই মামলায় অজ্ঞাত পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো)

ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রতিবাদমুখর। এই আন্দোলন থেকে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে আসছে যে এমন ঘটনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আগেও ঘটেছে। আগেরগুলোর বিচার হয়নি। কেন বিচার হয়নি, তার কারণও শিক্ষক-ছাত্রদের ভাষ্যে প্রকাশ্য হয়েছে—ক্ষমতার বিরুদ্ধে হাঁটার ভয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগের মতো এবারও বিচারহীনতার পথ অনুসরণ করলে উদ্বেগের জায়গাটি আরও গভীর হবে নিশ্চিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান সাধারণত পাঁচ বছরের বেশি হয় না। অর্থাৎ প্রায় সমবয়সীরা পড়ছেন সেখানে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা থাকার কথা। সেখানে উল্টো যৌন নিপীড়ন করার মনোভাব তৈরি হয়েছে ভাবলেও কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে ঘটনাগুলো বাড়ছে—এই লজ্জা তাঁরা রাখেন কোথায়?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের প্রতিবাদের ঘটনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালে শিক্ষার্থী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের আলোচিত আন্দোলনের কথা মনে পড়ল। ওই সময় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, কোনো কোনো প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় পুলিশ সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে, অভিযুক্ত পাঁচজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীর বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করার অভিযোগ ওঠে। ওই সময়ও কিছু প্রতিবাদ হয়েছিল। তবে তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিচারহীনতার ফল হিসেবে একই ঘটনা আবার ঘটেছে বললে কি ভুল হবে! এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী শাটলে ও বাসে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। কোনো বিচার হয়নি।

সর্বশেষ সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রসহ চারজনকে র‌্যাব আটক করেছে। তাঁদের কাছ থেকে ওই ছাত্রীর মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছে।চারজনের মধ্যে দুজন ছাত্রলীগের কর্মী। দেরিতে হলেও যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে এ ঘটনায় অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের অকার্যকর করে রাখার মতো অভিযোগ আমরা পাচ্ছি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুবর্ণা মজুমদার বলেন, ‘ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ। একটা ঘটনারও বিচার হয়নি। নিপীড়নবিরোধী একটা সেল রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ওই সেল তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই সেলকে পুরোপুরি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ছাত্রীরা সেলে অভিযোগ নিয়ে গেলে অভিযোগ কমিটির কর্তাব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে অভিযোগটিতে গুরুত্ব দেন না। অভিযোগ আমলে নিলেও দিনের পর দিন প্রতিবেদন ফেলে রাখা হয়। সেলে যাঁরা আছেন, তাঁরা সুনির্দিষ্ট ওই ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের চটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হতে চান না। এ কারণে প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। কারণ, ক্যাম্পাসের ভেতর ছাত্রীদের সঙ্গে ঘটা বেশির ভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই জড়িত থাকার খবর আমরা সবাই জানি।’ (সূত্র: প্রথম আলো)

যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে যাঁরা আছেন, তাঁরা কখনো নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে দেখেছেন কি না, প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। আরেকটু নিষ্ঠুরভাবে বলতে ইচ্ছা করে, ওই মেয়েটির জায়গায় আপনার সন্তান হলে কী করতেন? কানে তুলা গুঁজে নিজের পিঠ আর কত বাঁচাবেন?

যৌন নিপীড়নের যেকোনো ঘটনায় একটি পক্ষ নারীর পোশাক, সঙ্গে কে ছিল, একা থাকলে একা কেন ছিল, রাতের ঘটনা হলে রাতে কেন বাইরে গেল ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে নারীর প্রতি অভিযোগের পাল্লা ভারী করে ফেলে এবং অভিযোগটিকে হালকা করে ফেলে। বিচারপ্রক্রিয়া ঢিলা করতে এসব অসংবেদনশীল ভাবনাই যথেষ্ট। যারা বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাঁদের মধ্যে এমন ভাবনা কতটা ভয়াবহ তা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা থেকেও বোঝা যায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষক তাঁর সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগের ১০ মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন রোধ কমিটি জানায়, ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা হওয়ায় যৌন হয়রানির অভিযোগটি তারা বিবেচনা করেনি। আর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের প্রমাণ পাননি। গত বছরের আগস্টে অভিযোগ ওঠার পর ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এ বছরের ৮ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভায় ওই শিক্ষকের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। (সূত্র: প্রথম আলো)

ওই নারী শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘একজন পটেনশিয়াল রেপিস্টকে (সম্ভাব্য ধর্ষক) লালনপালন করা প্রশাসনের কাছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা “ন্যায়বিচারের” আশায় অভিযোগ জানান, এটাই তো ধৃষ্টতা। যে অসংবেদনশীলতার সংস্কৃতি তাঁরা নিজ হাতে তৈরি করছেন, প্রার্থনা করি, তার বলি যেন তারা নিজেরাই না হোন।’

ওই নারী শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষকের সঙ্গে এখন তাঁকে (নারী শিক্ষক) একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হয়। এটা তাঁকে মানসিকভাবে আরও পীড়া দেয়। ওই নারী শিক্ষক বলেন, ‘ওই লোকের চেহারা দেখলেও ঘেন্না লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হওয়ার কথা মুক্তচিন্তার চর্চা। আর সেখানেই কিনা অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবানেরা মিলে যৌন হয়রানির চর্চা শুরু করেছেন। এ ধরনের অভিযোগের তদন্তের সঙ্গে যাঁরা জড়িত থাকেন, তাঁদের শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা খুব জরুরি। না হলে এরপর শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কেউই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ জানাতে আসবেন না।’

ওই পুরুষ শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিশ্চয়ই কখনো না কখনো নৈতিকতার পাঠ দেবেন। কোন মুখে দেবেন অবশ্য জানি না। ভবিষ্যতে তাঁরই কোনো শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হলে প্রতিবাদের সারিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের বাইরে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে (২০) দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন। ওই ঘটনায় বিচারের দাবিতে সারা দেশে প্রতিবাদ হয়েছিল। ঘটনার পর আসামিরা পালিয়ে গেলেও তিন দিনের মধ্যে ছয় আসামি ও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিজ ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে সরকারের এমন ব্যবস্থা নেওয়া প্রশংসার দাবি রাখে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদও ভালো ফল নিয়ে আসুক। সেই ফল যেন শুধু একটি ঘটনার জন্যই কার্যকর না হয়, তা যেন আগামীতে সব যৌন নিপীড়ন নিরসনে উদাহরণ হতে পারে।

মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ তৈরি না করতে পারে, তা হলে আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে সুদূরপ্রসারী কোনো ফল আসবে না। নিপীড়কেরাই প্রতিবাদের জায়গাগুলো দখলে নিয়ে তামাশা করবেন। তাই প্রতিবাদে শামিল হোন, বিচার করতেও ভূমিকা রাখুন, তা না হলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে কণ্ঠ হারিয়ে যাবে, কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না।

  • নাজনীন আখতার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো