ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলা
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলা

কোটা সংস্কার আন্দোলন কোন পথে যাচ্ছে

কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ এবং বিরাজমান ইস্যুতে সরকারের অনমনীয় মনোভাবের কারণে গত কয়েক দিনে কমপক্ষে সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সামনের দিনগুলোতে কী ঘটবে, তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোন পথে অগ্রসর হবে, সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণ যে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি, সেটা সহজেই লক্ষণীয়, আন্দোলনকারীরা তাঁদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তাঁরা কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকাসহ দেশজুড়ে অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

শিক্ষার্থীরা যখন প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করছিলেন, সেই সময়ে এবং গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে যা বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে তার বাইরে কিছুই বলা হয়নি—আদালতের মাধ্যমে সমাধান না আসা পর্যন্ত সরকারের কিছু করার নেই। আগেও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, একইভাবে এখনো এই কথা বলা যায় যে সরকার এ কথাগুলোই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে বলতে চাইছে না কেন? আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সরকার উদ্যোগী হয়ে আইনের সংস্কার করেছে এমন উদাহরণ আছে। ফলে নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের পথ আগেও ছিল, এখনো আছে।

এর জন্য আদালতের অপেক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। তদুপরি আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার কথা কেন রোববার রাতে এবং সোমবার সারা দিন ছাত্রলীগ কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য হলো না? তাঁরা কেন প্রধানমন্ত্রীর রোববার রাতের বক্তব্য অগ্রাহ্য করলেন কিংবা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন সোমবার ছাত্রলীগ জবাব দিতে প্রস্তুত বলে কার্যত নির্দেশ প্রদান করলেন, সেটাও বিবেচ্য।

প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, ‘ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’ এই আশাবাদকে সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ ‘ইঙ্গিত’ বলে বর্ণনা করছেন, যা সব বিবেচনায়ই উদ্বেগের বিষয়।

গত কয়েক দিনে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে শক্তি প্রয়োগের বাইরে আর কিছুই দেখা যায় না। সম্ভবত রংপুরে আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি ছোড়ার ভঙ্গির মধ্যেই সরকারের কৌশল প্রতিভাত হয়েছে। আগের যেকোনো বিক্ষোভের ঘটনার সময়—বিরোধী দলের ডাকা সমাবেশ কিংবা শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন যা-ই হোক—যা হয়েছে, দেখা গেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা তাঁদের জ্ঞাতসারে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি নিক্ষেপ করছে এমন ব্যক্তি, যার পরিচয় খুঁজে বের করতে হয়।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিস্তল নিয়ে হামলায় অংশ নেওয়া যুবক হাসান মোল্লাই সরকারের রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশলের আসল কথা হচ্ছে বল প্রয়োগ করে দমিয়ে দেওয়া। এভাবে সাময়িক সাফল্য অর্জনের ইতিহাস আছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে ভয়ের বিস্তার ঘটানোর এই চেষ্টা একসময় ভেঙে পড়ে। এর কিছু লক্ষণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের টিকে থাকার ক্ষমতা, তাঁদের দেওয়া স্লোগানের মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হামলা এসেছে, হুমকি এসেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে। কাজেই আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান।’ তার মানে সামনে সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে বা সরকার তেমন মনে করছে। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলন কেন ৭৫ বছর ধরে সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থাকা দল আওয়ামী লীগের জন্য অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করতে পারে, সেটা কি ক্ষমতাসীনেরা বুঝতে পারছেন? এ ধরনের বক্তব্য যে ইতিমধ্যে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিকে আরও বেশি সংঘাতময় করবে, সেটা যেকোনো ব্যক্তিই বুঝতে পারেন। এগুলো এই ধারণাই দেয় যে সমস্যার সমাধান নয়, সরকারের লক্ষ্য সম্ভবত শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করা।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের আরেকটি পদক্ষেপ হচ্ছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হলগুলো থেকে বের করে দেওয়া। এ বিষয়ে সরকারের আগ্রহ এতটাই ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কিন্তু ইউজিসির এই এখতিয়ার আছে কি না, সেটাও ভেবে দেখার সময় হয়নি।

শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট ডেকে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সভাগুলোর সংবাদের সূত্রে জানা গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ক্যাম্পাসেই আছেন। ক্যাম্পাসে দিনে এবং রাতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ বা পুলিশি অভিযানের সময় উপাচার্য বা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কাউকেই দেখা যায়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের প্রাঙ্গণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যখন আক্রান্ত হয়েছেন, উপাচার্য তখনো তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় খালি করে দেওয়ার এই কৌশল পুরোনো, জেনারেল এরশাদের শাসনের সময় এর পুনঃপুন ব্যবহার হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা বিধানের চেয়ে ক্যাম্পাসে যখন সংঘাত চলছে, পুলিশ ক্রমাগতভাবে হামলা করছিল, সেই সময়ে তাঁদের হল ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে অস্বীকার করায় পুলিশি অভিযানের হুমকির মাধ্যমে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে, তাকে উপহাস বললেও সামান্যই বলা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘সিন্ডিকেটের নির্দেশনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে’ শিক্ষার্থীরা ‘শান্তিপূর্ণভাবে আবাসিক হল ত্যাগ’ করায়  তাঁদের ধন্যবাদ জানানে হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ‘সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা’ করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় বুঝতে পারে যে মঙ্গল কামনা করাই তাঁদের কাজ নয়, তার ব্যবস্থা করার জন্য তাদের ভূমিকা আছে। তারা সেই ভূমিকা পালন করেছে কি না, এখন করছে কি না, সেটা তারা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখতে পারে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গল চাইলে এই সংকটের সময় কী করত, সেই তালিকা খুব দীর্ঘ নয়, দরকার ছিল তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। শুধু তা-ই নয়, অতীতেও তারা যদি মঙ্গল চাইত, তবে গত বছরগুলোতে অন্তত গেস্টরুম/গণরুমের বিপক্ষে ব্যবস্থা নিত, হলগুলোকে কার্যত ছাত্রলীগের হাতে সঁপে দিত না।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে হলে জিম্মি জীবন যাপন করেন, সে কথা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষ জানত না, তা হতে পারে না। তাদের এই ভূমিকা, দলের জন্য ভালো হয়েছে না তাদের জন্য; সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু এর পরিণতি যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থী কারও জন্যই ভালো হয়নি, তা গত কয়েক দিন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অবস্থা থেকে বোঝা যায়।

প্রায় দেড় দশক ধরে এককভাবে হলগুলো তাঁদের কবজায় রেখে ছাত্রদের বাধ্য করা হয়েছে তাঁদের সভা-সমাবেশ যোগ দিতে, তাঁদের কথায় চলতে। এখন ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতাদের হল থেকে বের করে দিয়েছেন, তাঁদের রুমগুলোতে ভাঙচুর হয়েছে। এই পরিস্থিতির শিকার যে প্রকৃত শিক্ষার্থীরা হননি তা নয়। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ অবস্থা অব্যাহত রাখার কাজে যে ভূমিকা রেখেছে, তার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।

সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি যেখানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, শক্তির জোরে দমনের যে পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, তা গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দায়িত্ব কেবল শিক্ষার্থীদের নয়; এই দায়িত্ব শিক্ষকদের, নাগরিকদের।

  • আলী রীয়াজ ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি