আনিসুল হকের গদ্যকার্টুন

পৃথিবী নামের মা কি তাদের আশ্রয় দেবে না?

ইসরায়েলের বোমা হামলা কেড়ে নিয়েছে ফিলিস্তিনি দুই যমজ শিশুর প্রাণ। দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের মরদেহ। হামলায় ওই শিশুদের মা ও তিন বোনও নিহত হয়েছেন। ৮ অক্টোবর, গাজার খান ইউনিসে।
ছবি: রয়টার্স

কাজী নজরুল ইসলামের একটা মর্মস্পর্শী কিশোর কবিতা আছে—চড়াই পাখির ছানা নিয়ে। একটা দালানে পাখির বাসা। একটা পাখির ছানা উড়তে শিখতে গিয়ে বাসা থেকে পড়ে যায়। পাখি মা অসহায়। দুষ্টু ছেলেরা পাখির ছানাটাকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে থাকে। তখন এগিয়ে আসে একটা মা-মরা ছেলে।

মা মরেছে বহুদিন তার, ভুলে গেছে মায়ের সোহাগ,

তবু গো তার মরম ছিঁড়ে উঠল বেজে করুণ বেহাগ।

মই এনে সে ছানাটিরে দিল তাহার বাসায় তুলে,

ছানার দুটি সজল আঁখি করলে আশিস পরান খুলে।

অবাক-নয়ান মা’টি তাহার রইল চেয়ে পাঁচুর পানে,

হৃদয়ভরা কৃতজ্ঞতা দিল দেখা আঁখির কোণে।

পাখির মায়ের নীরব আশিস যে ধারাটি দিল ঢেলে,

দিতে কি তার পারে কণা বিশ্বমাতার বিশ্ব মিলে।

এই কবিতা পড়লে আমাদের মন মায়ায় ভরে ওঠে। মা-মরা ছেলেটা পাখি মায়ের দুঃখ বুঝল। পাখির ছানাটাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিল।

প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি ছাপা হয়েছে। ৯ অক্টোবর ২০২৩। দুটো ছোট্ট শিশু কাফনে মোড়া। লোকজন তাদের নিয়ে যাচ্ছে দাফন করাবে বলে। শিশু দুটো ফিলিস্তিনি। গাজার খান ইউনিসের ঘটনা। শিশু দুটো যমজ। ইসরায়েলের বোমা হামলায় এই শিশুদের মা এবং আরও তিন বোন মারা গেছে। আমরা একটা পাখিছানা পাখির নীড় থেকে পড়ে গেলে দুঃখ পাই। তাকে যদি একটা ছেলে মায়ের ডানাদুটোর নিচে ফিরিয়ে দেয়, সে কাহিনি শুনে মমতা বোধ করি। কিন্তু এই মানবশিশুদের মৃত্যুর জন্য কাঁদবে কে?

তারও আগে আমরা জানি, ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের সদস্যরা একটা মারাত্মক হামলা সংঘটিত করেছে। তাতে শত শত মানুষ মারা গেছে। এখন আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান, ইতিহাসের তথ্য এই সমুদয় হামলার পক্ষে-বিপক্ষে লাখ লাখ পৃষ্ঠা হাজির করতে পারে।

ফিলিস্তিনিদের তাদের বাসভূমি থেকে উৎখাত করে ইসরায়েলিদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন ফিলিস্তিনিরাই নিজ বাসভূমে পরবাসী। তাদের চলতে দেওয়া হয় না, সমুদ্রবন্দর দেওয়া হয় না। এ ইতিহাস দীর্ঘ এবং আমাদের বিশ্বসভ্যতার অন্যায্যতার চরম উদাহরণ। অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াই করতে গিয়ে তারা হামলা করে। এটাকে পশ্চিমাসভ্যতা সংজ্ঞায়িত করে সন্ত্রাসবাদ বলে।

বিশ্ব ব্যবস্থার মোড়লেরা চাইলে কি এত বছরেও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে পারত না? তা তারা করবে না, কারণ, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা—এসবই আপেক্ষিক। যার ক্ষমতা আছে, মানবাধিকার শুধু তার জন্য। সংজ্ঞা তাদের পক্ষে নির্ধারিত হয়।

ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এই অজুহাত চালিয়ে ইরাকে হামলা করা হলো। এর ফলে ২ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ ১৫ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। যুদ্ধের কুফলে মারা গেছে আরও কত লাখ, তার হিসাব নেই। গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি। ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কি মানুষ নয়? তারা কি মায়ের পেট থেকে জন্মায়নি? তাদেরও কি জীবনে হাসি-কান্না, আনন্দ-বিচ্ছেদ ছিল না?

ইসরায়েলের শিশু-নারী-বেসামরিক মানুষের মৃত্যুও একই রকম দুঃখজনক। ফিলিস্তিনি শিশু-নারী-বেসামরিক মানুষদের মৃত্যুও একই রকম দুঃখজনক। প্রত্যেক মানুষের রক্তের রং লাল। প্রত্যেকের চোখের জল একই রকম। এখন ইসরায়েলে হামাসের হামলার চরম প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমেরিকা রণতরী পাঠাচ্ছে। গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খাবার সরবরাহ বন্ধ। বোমা ফেলা হচ্ছে অবিরাম। ফিলিস্তিনিরা মানুষের সন্তান নয়? তাদের মানবাধিকার নেই? তাদের জন্য জেনেভা কনভেনশন নেই? একটা পাখির মৃত্যুও মানুষ সহ্য করতে পারে না।

আচ্ছা, ওই গল্পটা আবার বলি। আমাদের ছোটবেলায় বাসায় একটা ময়না পাখি ছিল। সে বলত, ‘অতিথি এসেছে, বসতে দাও।’ একদিন দুপুরে মা ঘুমিয়ে আছেন। চোর এল বাড়িতে। পাখিটা বলে উঠল, ‘অতিথি এসেছে, বসতে দাও।’ মা জাগলেন। চিৎকার করলেন। পড়শিরা ছুটে এল। চোরটাকে ধরে থানায় পাঠাল। কদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে চোরটা আবার এল বাড়িতে। সেদিন বাড়ি ছিল ফাঁকা। চোরটা ময়না পাখিটাকে ধরল, একটা পাথরের ওপরে তার মাথাটা চেপে ধরে আরেকটা পাথর দিয়ে বাড়ি মারল। মগজ ছিটকে গেল পাখিটার।

বাড়িতে ফিরে এসে ময়না পাখিটার রক্তাক্ত দেহ দেখে খুব কেঁদেছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা পাখিটাকে উঠানের শিউলিতলায় পুঁতে দিই। আজও বৃষ্টির দিনে শিউলিতলায় গেলে সেই পাখির কথা মনে পড়ে। একটা পাখির জন্যও আমাদের মন খারাপ হয়। এতগুলো মানুষকে মানুষই হত্যা করছে। এই সভ্যতা তবু নির্বিকার! এই গণহত্যাকারী সভ্যতা তার এত অন্যায় নিয়ে কত দিন টিকবে? কবে মানুষ মানুষ হবে? আর কবে?

গাজা উপত্যকায় বিদ্যুৎহীন পানিহীন খাদ্যহীন বাড়িতে যেসব শিশু বোমারু বিমানের শব্দে মায়ের বুকে লুকাতে চাইছে, পৃথিবী নামের মা কি তাদের আশ্রয় দেবে না?

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক