পরিবেশ রক্ষায় চট্টগ্রামের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এটা খুব আশার কথা। সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ আমাদের উৎসাহিত করছে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের পরিবেশ ধ্বংস করারই প্রতিযোগিতা হয়েছে শুধু। পরিবেশের দিক থেকে প্রায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েই মানুষের টনক নড়ছে। প্রকৃতি অকৃপণ হাতে আমাদের দান করেছিল পাহাড়, নদী, হ্রদ, মাঠ আর বনবনানী। সেসবের কিছুই আমরা অবশিষ্ট রাখিনি। মানুষের স্বার্থের থাবা সবখানে পড়েছে। প্রকৃতিকে খণ্ডিত করেছি, গ্রাস করেছি। তার তাই পরিবেশ হয়েছে বিপন্ন।
প্রকৃতি আর পরিবেশ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। প্রকৃতি ধ্বংস করা মানে পরিবেশ বিপন্ন করা। আর পরিবেশ বিপন্ন হয়ে মানুষের জীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে। আর এই বিপর্যয়ের মধ্যেই চট্টগ্রামের সচেতন মানুষের মধ্যে প্রকৃতিকে বাঁচানোর একটা আকুতি আমরা লক্ষ করছি। পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট, খাল দখলের চলমান দস্যুতার মধ্যেও মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে।
সিআরবির সবুজ চত্বর ধ্বংস করে সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগকে থামিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। মানববন্ধন, পথনাটক, চিত্র প্রদর্শনী, সভা-সমাবেশ, কবিতা-ছড়া পাঠের আসর, বিবৃতি প্রদান থেকে শুরু করে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে অবশেষে সরকারের কাছ থেকে ঘোষণা এসেছে ওখানে হাসপাতাল হবে না। ঐক্যবদ্ধ মানুষ যেকোনো কিছুতে সফল হয়। আবার প্রশাসনের সদিচ্ছায় অনেক শুভ কিছুর সূচনা হতে পারে, তারও প্রমাণ পেয়েছি আমরা সাম্প্রতিক চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামের সব দিঘি-জলাশয়কে বাঁচাতে হবে। তা আমাদের স্বার্থেই। পাহাড়-সংক্রান্ত বৈঠকে আক্ষেপ করে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম বলেছিলেন, কর্তিত, খণ্ডিত ও হারিয়ে যাওয়া পাহাড়কে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ যদি খ্যাপা হন, প্রশাসন যদি কঠোর ও আন্তরিক হয়, তবে ভূমি জরিপ অনুযায়ী, খতিয়ান দেখে যেখানে যে পুকুর-দিঘি ছিল, সেখানে আবার তা খনন করা যায়। তবে সেটির জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের ধৈর্য, আন্দোলন।
চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশে আউটার স্টেডিয়ামটি অবৈধ দখলদারদের কবল পড়ে একেবারে নিঃশেষ হতে চলছিল। বাংলাদেশের বহু নামকরা ক্রীড়াবিদের আঁতুড়ঘরের মতো প্রান্তরটি বছরের প্রতিটি মাসে মেলা বসত। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন মাঠটি উদ্ধার করে এটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। জেলা প্রশাসক আবুল বশর মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ঘোষণা দিয়েছেন, এখানে খেলা ছাড়া অন্য কোনো কিছু করার অনুমোদন দেওয়া হবে না। এতেই খুশি চট্টগ্রামের মানুষ।
কদিন আগে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পাহাড় কাটা প্রতিরোধে এক সভায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, যেকোনো উপায়ে পাহাড়খেকোদের রোধ করতে হবে। জেলা প্রশাসন সম্প্রতি আরেকটা ঘোষণা দিয়েছে, সেটিও আমাদের আশান্বিত করেছে। চট্টগ্রামের যেসব এলাকার সঙ্গে গাছের নাম জড়িয়ে আছে, সেখানে সেই গাছ রোপণের উদ্যোগ নেবে। আমতলায় সত্যি সত্যি আমগাছ, নিমতলায় নিম, জামাল খান লিচুতলায় লিচু থাকবে, এ রকম দৃশ্য কল্পনা করতেও আমরা পুলকিত হচ্ছি। এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেশি শ্রমসাধ্য নয়, আবার অতিরিক্ত ব্যয় বহনও করতে হয় না। শুধু দরকার আন্তরিকতা। অথচ এমন ছোট উদ্যোগে একটা এলাকার পুরো চেহারাটাই পাল্টে দেবে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের আরেকটি আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনের নাম ‘জলাশয় বাঁচাও আন্দোলন’। চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একসময় একাধিক পুকুর, দিঘি ছিল। পাহাড়ের নাম দিয়ে যেমন এলাকার নাম হয়েছে, তেমনি পুকুর-দিঘির নামেও অনেক এলাকাকে চেনা যেত চট্টগ্রামে। এখন সেখানে নাম আছে, কিন্তু পুকুর কিংবা দিঘি নেই। যেমন দেওয়ানজি পুকুরপাড় একটি এলাকার নাম। সেখানে দেওয়ানজিও নেই, তার পুকুরও নেই। রথের পুকুরপাড় এলাকাতে প্রতিবছর অবশ্য রথযাত্রার উৎসব হয়, কিন্তু পুকুর কোথাও হাওয়া হয়ে গেছে। আন্দরকিল্লাহর রাজাপুকুরে রাজা স্নান সারতে আসেন না, কেননা সুউচ্চ ভবনের নিচে সেই পুকুর চাপা পড়ে গেছে।
গরিবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশে চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত মনোরম এক প্রাকৃতিক হ্রদ ছিল, চট্টগ্রামের মানুষ যেটাকে ডেবা বলেই জানে। এখন সেখানে শত শত আবাসিক ভবন। হ্রদ তো গেছেই, পাহাড়ও সাবাড় হয়ে গেছে।
এ রকম আরও অনেক নামী পুকুরের নাম উল্লেখ করা যায়, যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব আর নেই, যেমন চান্দগাঁওয়ের মৌলভি পুকুর, ফিরিঙ্গীবাজারের ধাম্মো পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলীর সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর ও উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, ষোলশহর হামজারবাগ এলাকার হামজা খাঁ দিঘি, খতিবের হাট পুকুর।
চট্টগ্রামের পাহাড় আর মাঠের মতো জলাশয়ও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের রোষানলে পড়েছে বহু বহু বছর ধরে। গত ৪০ বছরে ২০ হাজারের বেশি পুকুর-দিঘি নেই হয়ে গেছে চট্টগ্রাম জেলায়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এক গবেষণা জরিপে সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে সরেজমিন জরিপ চালিয়ে মোট ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয়ের সন্ধান পায়। এর আগে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ২৫০টি জলাশয় পাওয়া যায়। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫২৩টি জলাশয়।
হিসাব করে দেখা যায়, প্রতিবছর চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ১০ শতাংশ করে কমছে। এখন অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে এনায়েত বাজার এলাকার রানির দিঘি, দামপাড়ার মসজিদ গলির পুকুর, কাজীর দেউড়ির পাশে আসকার দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়ার দিঘি, কাজীর দিঘি ও রামপুর বড় পুকুর। এসব জলাশয়কে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে চট্টগ্রামকে বাঁচানো যাবে না। পুকুর, পাহাড়, মাঠ, বনানী বিলুপ্তির কুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়া, সুপেয় পানির সংকট, অগ্নিকাণ্ডের সময় পানির দুষ্প্রাপ্যতা—এই সবই হচ্ছে চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে।
চট্টগ্রামের পাহাড় নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় যেমন চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক হয়েছেন, তেমনি পুকুর জলাশয় রক্ষার জন্য সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। সিআরবি রক্ষার আন্দোলনের যেভাবে চট্টগ্রামের সব মানুষ এক হয়েছেন, তেমনি জলাশয় বাঁচাও আন্দোলনকেও সফল করার জন্য সবাইকে সংযুক্ত হতে হবে। জলাশয় বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ছড়াকার আলেক্স আলীমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পুকুর, দিঘিগুলো বাঁচাতে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। ইতিমধ্যে বিপন্ন বলুয়ার দিঘি নিয়ে তাঁরা প্রচারণায় নেমেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছেন। এতে কাজ হয়েছে, জেলা প্রশাসক বলুয়ার দিঘিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে বলে কথা দিয়েছেন।
শুধু বলুয়ার দিঘি নয়, চট্টগ্রামের সব দিঘি-জলাশয়কে বাঁচাতে হবে। তা আমাদের স্বার্থেই। পাহাড়-সংক্রান্ত বৈঠকে আক্ষেপ করে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম বলেছিলেন, কর্তিত, খণ্ডিত ও হারিয়ে যাওয়া পাহাড়কে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ যদি খ্যাপা হন, প্রশাসন যদি কঠোর ও আন্তরিক হয়, তবে ভূমি জরিপ অনুযায়ী, খতিয়ান দেখে যেখানে যে পুকুর-দিঘি ছিল, সেখানে আবার তা খনন করা যায়। তবে সেটির জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের ধৈর্য, আন্দোলন। মামলা প্রতি-মামলায় কেটে যাবে বহু বছর। তবু শুরু করা দরকার। কিন্তু যেসব জলাশয় দখলের প্রক্রিয়ায় আছে, এখনো ক্ষীণভাবে টিকে আছে, সেগুলো রক্ষা করতে এত দীর্ঘসূত্রতার প্রয়োজন হবে না।
আউটার স্টেডিয়াম ও অন্যান্য বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক যে রকম মনোভাব দেখিয়েছেন, জলাশয়ের ব্যাপারেও আমরা তাঁর কাছ থেকে যুগোপযোগী পদক্ষেপ আশা করছি। তবে এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষকেও সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের হারানো স্মৃতির মতো ফিরে আসুক পুকুর, দিঘি। পাহাড় ফিরিয়ে আনতে না পারার দুঃখ ঢেকে যাক পুকুর ফিরে পাওয়ার আনন্দে।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক