মতামত

সব দলই যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, জনগণ ভোট দিতে পারে না কেন?

যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেরার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছিল, তারা নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন
ছবি : প্রথম আলো

যাঁরা ভেবেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি বা দুটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এলেই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে যাবে, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর প্রতিনিধিরা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, তা নতুন নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হাতে পারে, তাও তারা জানেন। কিন্তু মানেন না।

১২ জুলাই একই সময়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দেখে অনেকে আহ্লাদিত হয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সুমতি হয়েছে। ওই দিনের সমাবেশে নেতা-নেত্রীদের ভাষাও অনেক সংযত ছিল।

আগের মতো প্রতিপক্ষের প্রতি রোষ নিক্ষেপ না করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচনটা করতে হবে। সংবিধানের ভেতরে থাকা মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। বিএনপির নেতারা বলেছেন, সেটা হবে না। আমরা ২০১৮ সালে সরকারকে বিশ্বাস করে ঠকেছি। ন্যাড়া আর বেলতলায় যাবে না।

আওয়ামী লীগ যদি এতই জনপ্রিয় হয়ে থাকে, তারা ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন করে না কেন? একই কথা বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও বিএনপিকে বলেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে কলাকুশলী বদলায়। চরিত্র বদলায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেরার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছিল, তারা নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সঙ্গেও তাদের কথা হয়েছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেন নি। আলাদাভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেনি। ফলে বিএনপির নেতাদের সঙ্গেও তাদের কথা হয়নি।

এটাকে সরকারি দল নিজেদের সফলতা হিসেবে দেখতে পারে। তারা বলতে পারে, বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, তার সঙ্গে ‘বিদেশিরা’ নেই। আবার কেউ কেউ এর পাল্টা যুক্তিও দিতে পারেন। যেহেতু ভোট নিয়ে সমস্যাটি ক্ষমতাসীনেরা তৈরি করেছেন, মার্কিন প্রতিনিধিদল তাদের সঙ্গেই কথা বলবে। গত ১৪ বছরে বিএনপি তো কারও ভোটাধিকার হরণ করেনি।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি পালা করে ৫২ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তার আগে জাতীয় পার্টি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা নির্বিচনী ইশতেহার অনুযায়ী দেশ চালাবে, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়, তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিপরীতেই কাজ করেছে। ফলে জনগণের ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে তাদের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে ভাটা পড়ে। এ কারণেই সব দলকে ভোটযুদ্ধে জেতার জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।

আমাদের রাজনীতিতে একেক সময় একেক আওয়াজ ওঠে। এরশাদের আমলে আওয়াজ উঠল, ‘স্বৈরাচারকে হটাও।’ স্বৈরাচারী এরশাদ বিদায় নেওয়ার পরও তিনি যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থাটা রেখে গিয়েছিলেন, সেটার পতন হয়নি। খালেদা জিয়ার শাসনামলে সব বিরোধী দল মিলে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করল। কিন্তু নির্বাচনী সংকটের সমাধান হলো না। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল না। বিএনপিকে হটিয়ে মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাল। কিন্তু মানবাধিকা লঙ্ঘন, আইনের শাসনের ঘাটতি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত বন্ধ হলো না। এমনকি নির্বাচনের ব্যাপারেও তারা পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করল।

বাংলাদেশ গণতন্ত্রের প্রত্যয় নিয়ে ৫২ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের সমস্যাটা রয়েই গেছে। প্রতিবারই নির্বাচন এলে বিদেশিরা এসে আমাদের সবক দিয়ে যান। পরামর্শ দেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সেটা মেনেও নেন। যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেননি বলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা উল্লসিত। কিন্তু উজরা জেয়া যেখন বাংলাদেশে এসে বলেন, ‘আসুন আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই’ সেটা মোটেই সম্মানজনক নয়।

তাঁর এই আহ্বানের মধ্যে যে কথাটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে, সেটি হলো বাংলাদেশে জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ এখন নেই। বাংলাদেশের কোনো কোনো জুনিয়র কিংবা সিনিয়র মন্ত্রী যদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে সেই দেশের রাজনীতিকদের কাছে জনগণের ভোটাধিকার কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসতেন, সেটাকে সেই দেশের মানুষ কি হৃষ্টচিত্তে নিতেন? রাজনীতিকের বিগলিত হয়ে যেতেন?

মার্কিন প্রতিনিধিদল এসেছিল চার দিনের সফরে। ইইউর প্রতিনিধিদল এসেছে দুই সপ্তাহের সফরে। তারা এখানে নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। ১৫ জুলাই তারা বসেছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে। তারা সব দলের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করেছেন। নিজেরা কোনো মন্তব্য করেননি।

ইইউর সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলেছেন, বিএনপির নেতারা ঠিক তার উল্টো বলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের আমলে নির্বাচনী আইন সংস্কারের নানা উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বিএনপির নেতারাও সাম্প্রতিক ও অতীতের হামলা-মামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবে সম্ভব নয়। জাতীয় পার্টি কৌশলী অবস্থান নিয়ে বলেছে, সরকার যতই সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলুক না, তাদের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থাকলে জনগণ নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারে। জামায়াতে ইসলামী বলেছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রহসনমূলক নির্বাচন হয়েছে।

ভবিষ্যতে একতরফা ভোট হলে  ইইউ’র পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে অর্থহীন।
ইইউর প্রতিনিধি দল দেশে ফিরে যে প্রতিবেদন দেবে, তার ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নেবে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি পাঠাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও বলে গেছেন, পরিস্থিতি দেখে তারা জানাবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের ‘কঠোর’ নজরদারিতে থাকবে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি পালা করে ৫২ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তার আগে জাতীয় পার্টি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা নির্বিচনী ইশতেহার অনুযায়ী দেশ চালাবে, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়, তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিপরীতেই কাজ করেছে। ফলে জনগণের ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে তাদের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে ভাটা পড়ে। এ কারণেই সব দলকে ভোটযুদ্ধে জেতার জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তারা সুষ্ঠু ভোট চান। বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা সুষ্ঠু ভোট চান। জাতীয় পার্টির নেতারাও সুষ্ঠু ভোট চান। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সবাই যদি সুষ্ঠু ভোট চায়, জনগণ ভোট দিতে পারে না কেন?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
      sohrabhassan55@gmail.com