এক পাহাড়ি ভদ্রলোক রাতের বাসে করে বান্দরবান থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। মাঝরাস্তায় যাত্রাবিরতি কুমিল্লায়। ভদ্রলোক বাস থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে আবার গাড়িতে উঠলেন। পরদিন ভোরে গাড়ি থেকে নেমেই তাঁর আক্কেলগুড়ুম! যে ঢাকা শহরে তিনি নামলেন, সেটা অবিকল তাঁর নিজের শহর বান্দরবানের মতো। পরে তিনি বুঝতে পারলেন, যাত্রাবিরতির পর তিনি ভুলবশত ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একই কোম্পানির আরেকটি গাড়িতে উঠে বসেছিলেন। ফলে রাতে যে শহর থেকে রওনা দিয়েছিলেন, ভোরবেলায় ইউটার্ন নিয়ে আবার সেই শহরেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নের হাল দেখে সেই ইউটার্ন নিয়ে ফেরত আসা ভদ্রলোকের কথাই মনে পড়ে!
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা মূলত একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়িরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পরে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বন্ধ হলে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়। যদিও তাঁরা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য আলোচনার পথও খোলা রাখেন। আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এরপর ১৯৮৫ সালের দিকে এরশাদ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। এই আলোচনায় ঐকমত্য তৈরি হয় রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য। সেই সূত্র ধরে এরশাদ সরকারের সঙ্গে ৬ বার, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সঙ্গে ১৩ বার এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ৭ বার—মোট ২৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটে।
আওয়ামী লীগ একচেটিয়াভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরের কৃতিত্ব নিতে চেয়েছে। তবে বলা যায়, দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দলেরই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে অবদান রয়েছে। আবার অন্যদিকে বলতে গেলে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিই আওয়ামী লীগকে বেছে নিয়েছিল চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল বিবেচনায়। সে ক্ষেত্রে, যে দলের সঙ্গেই চুক্তি হোক, চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ক্ষেত্রে কৃতিত্বের মূল দাবিদার হলো জনসংহতি সমিতি। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেগুলোও আসলে প্রাপ্য ছিল পাহাড়ের নেতা সন্তু লারমার।
এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি আদিবাসী পাহাড়ি (সরকারের ভাষায় ‘উপজাতীয়’) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে একটি ভূমি কমিশন গঠনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যার সমাধান, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর, সেনাশাসন প্রত্যাহার, অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন, শুধু স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সেই তালিকার মাধ্যমে জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে এবং প্রতিনিয়ত চুক্তি লঙ্ঘন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে না গিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল।
কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ২৭ বছর পরও মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে জনসংহতি সমিতি তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বরং চুক্তির বিভিন্ন বিষয় প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করেছে। চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের দলীয় লোকেদের পুনর্বাসন ও লুটপাটের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এর ফলে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে সম্ভাবনা ছিল, তা আর ঘটেনি।
চুক্তি স্বাক্ষর করার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর কোনোটাই বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটতে শুরু করছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অর্ধেক পথ থেকে আবার পেছনে ফিরে গেছে। ফলে চুক্তির আগে পাহাড় যে ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ছিল, সেই ধরনের রাজনৈতিক সংকট আবারও ঘনীভূত হচ্ছে।
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সাল থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ করে রেখেছিল। যদিও বিভিন্ন প্রতিবেদনে, বক্তৃতার মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রচার করেছিল যে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৭টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান। অন্যদিকে, জনসংহতি সমিতি তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি ২৯টি ধারা বাস্তবায়নের বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু, এসব ধারা নিয়মিত লঙ্ঘন করা হয়েছে।
চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই আংশিক বাস্তবায়ন করে অচল অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে নতুবা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রাখা হয়েছে। উদাহরণ দেওয়া যাক। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে ২০২২ সালে গঠিত পার্বত্য চুক্তিসম্পর্কিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৩৩ ও ৩৪ ধারার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত ধারাগুলোর মধ্যে ‘জেলার আইনশৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উন্নতি সাধন, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন’ বিষয়গুলো জেলা পরিষদগুলোয় হস্তান্তরের কথা রয়েছে। কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেগুলো এখনো জেলা পরিষদগুলোয় হস্তান্তর করা হয়নি।
আবার, চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিসম্পর্কিত যে ৩টি ধারা রয়েছে, তার মধ্যে ৪ নম্বর ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৫ ও ৬ নম্বর ধারাগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, গত ২৭ বছরে কোনো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি এবং পাহাড়িরা এখনো তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। জানা গেছে যে খাগড়াছড়িতে ভূমি কমিশনের কার্যালয়ে ২২ হাজার ৮৬৬টি দরখাস্ত জমা পড়ে। ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে বটে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল, তহবিল ও পরিসম্পদ নেই। ফলে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বাঙালি সেটেলারদের বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে ভূমি কমিশন সভা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।
চুক্তির মধ্যে আরও অনেক মৌলিক বিষয় রয়েছে, যা বিগত সরকার বাস্তবায়ন করেনি। অন্যদিকে, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন প্রতিনিধিকে আহ্বায়ক করে এবং চুক্তির আওতায় গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান এবং জনসংহতি সমিতির সভাপতিকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে একটি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের বিধান অনুযায়ী কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কোনো দপ্তর নেই। কমিটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো তহবিল প্রদান করা হয়নি। ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে এবং প্রতিনিয়ত চুক্তি লঙ্ঘন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে না গিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল।
সম্প্রতি ছাত্র–জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা, যাতে চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করা যায় এবং একটি রোডম্যাপের ভিত্তিতে চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়। কেবল তাহলেই চুক্তির যে মূল লক্ষ্য, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান, তা অর্জন করা সম্ভব হবে।
মিলিন্দ মারমা: আদিবাসী অধিকার কর্মী
milinda.marma@gmail.com