লোহিত সাগরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলার কারণে চীনের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
লোহিত সাগরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলার কারণে চীনের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

হুতির বিরুদ্ধে চীন যে কারণে যুদ্ধ করবে না

চীনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সজ্জিত: এক. কোন বিষয়কে চীন হুমকি বলে মনে করে। দুই. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে যে কৌশলনীতি তারা প্রণয়ন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে চীন তিন ‘না’ নীতি মেনে চলে। এই তিন ‘না’ হলো: কোনো সহযোগিতা নয়, কোনো সমর্থন নয় ও কোনো সংঘাত নয়। এই মূলনীতির কারণে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলের পথে ইরান-সমর্থিত হুতিরা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালেও চীন তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় হুতিরা লোহিত সাগরে আক্রমণ পরিচালনা করছে। এই আক্রমণে চীনের পতাকাবাহী জাহাজ সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে না। গত মাসে হুতির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘোষণা দেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়—এমন কোনো জলযানে তারা হামলা করবে না।

কিন্তু হুতিদের আক্রমণ চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রভাব ফেলছে। তার কারণ হলো, চীনের পতাকাবাহী জাহাজগুলোকে এখন ইসরায়েলের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা পণ্য পরিবহনে বিরত থাকতে হচ্ছে।

কিন্তু একটা জাহাজ কোন দেশের, তা শনাক্ত করার কাজটি সব সময় খুব সহজ ব্যাপার নয়। সে কারণে চীনের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ রয়েই যাচ্ছে। কিন্তু লোহিত সাগর এড়িয়ে অন্য পথে জাহাজ চলাচল বেশ ব্যয়বহুল। লোহিত সাগরে বৈশ্বিক বাণিজ্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল একটি করিডর।

চীনের জাহাজ যদি ইউরোপে যেতে চায়, তাহলে লোহিত সাগরের বিকল্প পথ হচ্ছে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাওয়া। প্রচলিত পথ সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপে যেতে যেখানে ২৬ দিন লাগে, সেখানে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যেতে দরকার হয় ৩৬ দিন। তাতে রপ্তানি বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যায় অনেকটাই।

দীর্ঘ পথ ঘুরে জাহাজ এলে আমদানি খরচও বেড়ে যায়। সেটা চীনের মূল্যস্ফীতির ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম যদি বেড়ে যায়, তাহলে এরই মধ্যে মন্দভাবে থাকা চীনের অর্থনীতি আরও বড় চাপের মধ্যে পড়বে। সুতরাং লোহিত সাগরে হুতিরা চীনের জাহাজে সরাসরি আক্রমণ না করলেও তাতে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে, যদি হুতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের চলমান সংঘাতে ইরান জড়িয়ে পড়ে। সেটা হলে হরমুজ প্রণালি আক্রান্ত হবে এবং চীনের জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি হবে।

এখন পর্যন্ত হুতিরা যে হুমকি তৈরি করছে, সেটাকে চীন মধ্যম পর্যায়ের বা চূড়ান্ত হুমকি বলে মনে করছে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে চীনের কর্মকর্তারা ইরানের কর্মকর্তাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তাঁরা হুতিদের ওপর চাপ দেন। কিন্তু ইরানের ওপর চীনের কিছু মাত্রায় প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বেইজিংয়ের পক্ষে তেহরানের নীতি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ খুবই কম। আবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও হুতিদের ইরান পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেটাও নয়। আপাতভাবে যুক্তরাষ্ট্র যা–ই ভাবুক না কেন, কূটনৈতিক পথে হুতিদের লাগাম টেনে ধরার সামর্থ্য চীনের সীমিত।

আর চীনও খুব বেশি দূর এগোবে বলে মনে হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত চীনের কৌশলনীতিপ্রণেতারা মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের লেন্স দিয়ে দেখবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাও চীনের জন্য খারাপ কোনো ব্যাপার নয়। চীনের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে দুর্দশায় (মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক) পড়েছে, তা দেখে আনন্দ পাওয়া লোকের ঘাটতি নেই।

কোনো পরিস্থিতিতেই চীন হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজোটে যুক্ত হবে না। এটা শুধু চীনের প্রথম ‘না’ নীতির কারণেই নয়; ইসরায়েল ও আরব বিশ্ব এবং সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে চীন যে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতিতে চলছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু লোহিত সাগরে হুতির কর্মকাণ্ড তো চীনের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তাহলে চীনের সামনে বিকল্প কী?

চীন এটা ভালো করেই জানে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে (ইউক্রেন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে বিশাল অর্থ ঢালতে হচ্ছে), তাহলেই তারা কেবল লাভবান হতে পারে।

এটা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র এখন যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়েছে, সেই সুযোগে চীন তাইওয়ানের দিকে অগ্রসর হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্বের অবক্ষয় চীনের জন্য উপভোগ্য। ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যত দীর্ঘ হবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সংহত করার তত বেশি সুযোগ পাবে চীন। আর মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীন ততই নিজেকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে পারবে।

কোনো পরিস্থিতিতেই চীন হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজোটে যুক্ত হবে না। এটা শুধু চীনের প্রথম ‘না’ নীতির কারণেই নয়; ইসরায়েল ও আরব বিশ্ব এবং সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে চীন যে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতিতে চলছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু লোহিত সাগরে হুতির কর্মকাণ্ড তো চীনের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তাহলে চীনের সামনে বিকল্প কী?

একটা সম্ভাব্য পথ হচ্ছে লোহিত সাগরে চীনের নৌবাহিনীর পাহারায় তাদের কার্গো জাহাজগুলো চালানো। ২০০৮ সাল থেকে এডেন উপসাগরে জাহাজ চলাচলে চীন সেটা করে আসছে। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংবিধির ওপর ভিত্তি করে এডেন উপসাগরে জাহাজে পাহারা দিচ্ছে চীন। লোহিত সাগরের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো সংবিধি না থাকায় চীন এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক। তারপরও সম্প্রতি চীন লোহিত সাগরে সেটা শুরু করেছে।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য সংকটে চীনের জন্য সবচেয়ে সহজ ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক পথটা ভিন্ন। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে যে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে চীন। তারা বলছে, চলমান সংকটের যেকোনো বাস্তবসম্মত সমাধানের পূর্বশর্ত দুই রাষ্ট্র সমাধান।

চীন এটা ভালো করেই জানে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র সমাধান শিগগির বাস্তবায়ন হওয়ার নয়। কেননা, তাতে ইসরায়েল ও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে বদলে যাবে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে সম্ভবত দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি মূল প্রশ্ন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে খর্ব করাই মূল প্রশ্ন।

  • ইয়ান সান স্টিমসন সেন্টারের পূর্ব এশিয়া কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ফেলো ও সহপরিচালক এবং চীন কর্মসূচির পরিচালক

     ইংরেজি থেকে অনূদিত, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট