বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, কুড়িগ্রামে মোট নদীর সংখ্যা ১৬। এই ১৬ নদীর কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসা হচ্ছে। কিন্তু নদীর কাজ সরেজমিন করতে গিয়ে দেখেছি এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক। সশরীর ৫০টি নদীর পাড়ে গিয়েছি। কুড়িগ্রামের প্রথম আলো এর সংবাদদাতা জাহানুর রহমান খোকন আরও কয়েকটি নদীর সন্ধান দিয়েছেন।
কুড়িগ্রামের সীমানায় আছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় রাজ্য। সংগত কারণে এ জেলায় আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যাও বেশি—অন্তত ১৯টি। দেশে ভারত থেকে যে পানি আসে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানির পরিমাণ বিবেচনায় বোঝা যায় এ জেলায় নদীর সংখ্যা অনেক হওয়াই স্বাভাবিক।
পাউবো প্রকাশিত নদীবিষয়ক একটি ফোল্ডারে উল্লেখ করা কুড়িগ্রামের নদীগুলো ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, গঙ্গাধর, দুধকুমার, ফুলকুমার, বুড়িতিস্তা, নীলকমল, বোয়ালমারী, সোনাভরি, হলহলিয়া, শিয়ালদহ, ধরণী, জালছিড়া, জিঞ্জিরাম ও কালজানি। এর ১২টি আন্তসীমান্ত নদী। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদী বারোমাসি, গিরাই (নাগেশ্বীতে আরও দুটি গিরাই নদী আছে), গদাধার, তোরশা, শঙ্কোষ, কালো ও নওজল। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে এ জেলার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরাম আছে। বাকিগুলোরও স্বীকৃতি জরুরি।
কুড়িগ্রামের অন্যান্য নদী—অন্তাই, বামনী, কোটেশ্বর, দেউল, নাগেশ্বর, পয়রাডাঙ্গা, নাগদহ, গোদ্ধার, ঘড়িলাডাঙ্গা, চণ্ডীমারী, চাকিরপশার-মরাতিস্তা-বুড়িতিস্তা, হাওরার বিল, হাড়িয়ার ডারা, রতনাই, বুড়া ধরলা প্রভৃতি।
সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, ‘সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।’ এ কথা বলার একটি বড় কারণ দেশের অধিকাংশ নদীর পানি এই প্রবাহে মিলিত হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদীর পরিচর্যা কোনোকালেই করা হয়নি। আবার একে প্রাকৃতিকভাবেও প্রবাহিত হতে দেওয়া হয়নি। ফলে নদীটি ক্রমশ ভরাট হতে হতে দুকূল ভেঙে তার প্রশস্ততা বাড়িয়েছে। বর্ষা মৌসুমে কোথাও কোথাও প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রস্থে রূপ ধারণ করে। বর্ষায় নদীর পাড়ে দাঁড়ালে সমুদ্রের মতো মনে হয়।
তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্য নদীগুলোরও একই অবস্থা। সেগুলোর পরিচর্যা না থাকার কারণে নদীর ভাঙন আর ভয়াবহ বন্যায় কুড়িগ্রামের অর্থনীতি ক্রমশ নিম্নগামী। সর্বশেষ পরিসংখ্যানমতে, ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষই গরিব।
কুড়িগ্রামের অনেকগুলো নদীকে হত্যা করা হয়েছে। নাগেশ্বর নদীটি বিলুপ্তপ্রায়। নাগেশ্বরী উপজেলার অনেকেই জানেন না এই নদীর কথা। পয়রাডাঙ্গা নামে একটি নদী আছে ওই উপজেলায়। লেখক–গবেষক শাশ্বত ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেবী চৌধুরানী তিস্তা নৌপথ ধরে ধরলা হয়ে পয়রাডাঙ্গা নদী দিয়ে পয়রাডাঙ্গা এলাকায় যেতেন। সেখানে তঁার একটি কুঠি ছিল।’ বর্তমানে সেই নদীটিও বিলীনপ্রায়। যেটুকু আছে, সেখানে পুকুর কাটা হচ্ছে। ফুলবাড়ীতে গাগলা বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গিরাই নদ। বর্তমানে সেটিরও অবস্থাও করুণ।
কুড়িগ্রাম থেকে নাগেশ্বরীর পথে পাঁচগাছির ছড়া নামে ধরলার একটি শাখানদী ছিল। কিন্তু সড়ক নির্মাণ করার সময়ে এই নদীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখনো প্রায় প্রবাহহীন ১৫ কিলোমিটার সেটির অস্তিত্ব আছে। রাজীবপুর উপজেলায় জালছিড়া নামের নদীটিকে মেরে ফেলা হয়েছে মহাসড়ক তৈরি করার সময়ে। আড়াআড়ি সড়ক হয়েছে কিন্তু সেতু নেই।
কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ি নামক স্থানের পাশে ধরলা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রবাহিত হতো অর্জুনের ডারা নামের একটি নদী। এই নদীর কয়েকটি নাম—নয়ানদী, হাজির নদী, খলিসাকুড়ি, শিয়ালডুবি, সন্যাসীর ডারা, গর্ভেরদোলা। এই নদীটি ধরলার শাখানদী। কিন্তু বাঁধ দিয়ে ধরলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রাজারহাট কুড়িগ্রাম সড়কের পাশে একটি রেস্তোরাঁ–সংলগ্ন অবৈধ দখল আছে এ নদীতে।
কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ধরলা নদী থেকে চলছে প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন। অনেকেই বলছেন ধরলার পুরোনো প্রবাহ ভরাট করা হচ্ছে বর্তমান ধরলার বালু দিয়ে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, দখলদারেরা প্রভাবশালী। তাই সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।
রাজারহাটের ইটাকুড়ি স্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে উলিপুরের ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হতো একটি নদী। স্থানভেদে এর নাম চাকিরপশার, মরাতিস্তা ও বুড়িতিস্তা। পাউবোর তালিকায় নদীটির উল্লেখ আছে। ৩৫-৪০ বছর আগে তিস্তা থেতরাই এলাকায় বুড়িতিস্তার ভেতরে ঢুকে যায়। তখন নদীটি দুভাবে বিভক্ত হয়। যে অংশটি তিস্তার শাখানদী হয়েছে, সেখানে বাঁধ দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছে।
আর উৎসস্থল ইটাকুড়ি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পাঠানহাট (পূর্বের নাম বালার ঘাট) এলাকায় এ নদীর ওপর আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করে প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ নদীতে আছে ভয়াবহ দখল। চাকিরপশার এলাকায় নদীটি বিল শ্রেণিভুক্ত। এখানে প্রায় দেড় শ একর জমি অবৈধভাবে সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারিভাবে প্রবাহটি উন্মুক্ত করার কাজ চলছে।
বছরখানেক আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং রিভারাইন পিপলের আয়োজনে কুড়িগ্রামের নদ-নদী নিয়ে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে একজন জানালেন নীলকমল দখল হওয়ার কথা। আরেকজন জানালেন, দুধকুমার থেকে কীভাবে খননের নামে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে আবারও নদীতে ফেলা হয়েছে। আরেকজন বলেছিলেন নাগদহ নদীর সমস্যার কথা।
কুড়িগ্রামের অর্ধশত নদীর অধিকাংশই বিলুপ্তির পথে। বাকিগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। কুড়িগ্রামের নদীগুলো রক্ষা করতে হলে সরকারিভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কুড়িগ্রামের নদীগুলোর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা হলে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য তিলকের অভিশাপও দূর হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com