মতামত

কর্ণফুলীর নদীর চরে কেন বর্জ্য শোধনাগার?

কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রামের সচেতন মানুষের মনে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এটি বাস্তবায়িত হলে নানা রকম দূষণে এবং দখলে রুগ্ণ কর্ণফুলীর কফিনে শেষ পেরেকটি টোকার মতোই অবস্থা হবে।

চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলাধীন চর বাকলিয়া মৌজার ৩৫ একর জমিতে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনাটা চট্টগ্রামের কর্ণফুলীকে ধ্বংস করে দেবে। দেশের বৃহত্তম বন্দরকে ঘিরে সারা বছরের প্রতিটি ক্ষণ যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তার মূল ভিত্তি হচ্ছে কর্ণফুলী নদী।

কারণ এই নদীর মোহনার কাছেই চট্টগ্রাম বন্দর। কর্ণফুলীকে এই জন্যই দেশের প্রাণপ্রবাহও বলা হয়ে থাকে। বর্জ্য শোধনাগার স্থাপিত হলে এই প্রাণপ্রবাহ থেমে যাবে। দেশে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পরিবেশ ধ্বংস হবে। জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। কর্ণফুলীর দুই তীরে বিস্তীর্ণ জনপদের জনজীবনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

এই কারণেই পরিকল্পনাটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা। পরিবেশে ক্ষতিকারক এমন স্থাপনা নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের জন্য যে কোনো কঠিন আন্দোলনে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ‘কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চ’।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, আরএসকে ফাউন্ডেশন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন মিলে ছয়টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই মোর্চা যেখানে এই স্থাপনা গড়ার পরিকল্পনা চলছে, সেই কর্ণফুলীর চরে গিয়ে সমাবেশ করেছে এবং সংবাদ সম্মেলনও করেছে।

সমাবেশে তারা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার হলে পরিবেশের কী মারাত্মক ক্ষতি হবে। তারপরও সেখানে ভূমি নিরীক্ষার কাজ করছে চীন দেশের একটি প্রকৌশল কোম্পানি।

পরিবেশে ক্ষতিকারক স্থাপনা নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের জন্য যে কোনো কঠিন আন্দোলনে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ‘কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চ’।

গত রোববার চর বাকলিয়া দ্বীপে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কর্ণফুলী নদী গবেষক প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘নদী ভরাট হয়ে জেগে ওঠা দ্বীপ এমনিতেই কর্ণফুলীকে দুই ভাগ করেছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে এই চর বা দ্বীপে বিষাক্ত বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা আত্মঘাতী। এটি কর্ণফুলীকে হত্যা করবে। চসিক মেয়রকে এই কাজ করার কুপরামর্শ যারা দিয়েছে তারা দেশের শত্রু। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আধুনিক প্রজন্মকে নিয়ে এই অন্যায় প্রতিহত করবে।’

প্রতিবাদ মঞ্চের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জনগণের দাবি সসম্মানে মেনে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপন বন্ধ করুন। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা, যুব সমাজ সাম্পান মাঝিরা লাঠি বইঠা নিয়ে মেয়রের কার্যালয় ঘেরাও করা হবে। দেশকে ধ্বংস করে কার স্বার্থে কিসের এই প্রকল্প?’

কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উজানে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানের একটি চর। ১৯৩০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই দ্বীপ জেগে উঠে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চরটির পশ্চিম দক্ষিণ পাশে কিছুটা খনন করেছে। চরটির মোট আয়তন প্রায় ১০৫ একর বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে বর্তমানে চরটি সরকারি এক নম্বর খাস খতিয়ানে নদী শ্রেণির জমি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

এই চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার করার জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের একটি আবেদন ভূমি মন্ত্রণালয়ে করা হয়। বর্তমানে চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপনের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ চলমান রয়েছে।

কর্ণফুলী নদীর বুকে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ বিরোধী এই আন্দোলন সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের মতো জনপ্রিয়তা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ২৪ মার্চের সমাবেশ চট্টগ্রামের সচেতন বহু মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। সিআরবির পরিবেশ রক্ষায় যেমন সর্বস্তরের মানুষ যেমন অংশ নিয়েছে তেমনি এই আন্দোলনেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষ সাড়া দেবে। কারণ এটি আরও ব্যাপক এবং বিধ্বংসী।

কর্ণফুলীর সঙ্গে শুধু পুরো চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। এ কারণে এই নদীকে বাঁচাতে পরিবেশবাদী শুধু নয় সাধারণ মানুষও ইতিমধ্যে নানাভাবে কথা বলা শুরু করেছেন।

কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা বলেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মহামান্য হাইকোর্টের আদালতের রায়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকেও জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং মূলত এর মাধ্যমে মানুষের মতো নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প করা অবৈধ এবং আদালতের আদেশের লঙ্ঘন করে। সুতরাং এই প্রকল্প হতে পারে না।

আমাদের সংবিধানেও উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

কোটি মানুষের চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। বর্জ্য শোধনাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে জায়গায় এটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেটি মোটেও পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব এবং চট্টগ্রামবান্ধব হবে না। এই জন্য পরিবেশবাদীদের দাবি যত তাড়াতাড়ি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নেবে ততই দেশের মঙ্গল।

তার মানে জলাভূমি অর্থাৎ নদীর নিরাপত্তা বিধান সংবিধানস্বীকৃত এবং সেটি করতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র মানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করার সময় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেন। তারা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে নদীর অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প নদীর অধিকারকে হত্যা করবে। প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা জানান দেশের সংবিধান অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। নইলে এটি আইনবিরুদ্ধ কাজ হবে।

কর্ণফুলী নদীর প্রাণপ্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণ নিয়ে বন্দরনগর ভিত্তিক পরিবেশ সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইসিএইচও) ২০২২ সালে এক গবেষণা চালায়। তাতে দেখা গেছে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দূষণ রোধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়বে।

৫৩টি শিল্পসহ ৮৯টি উৎস থেকে কর্ণফুলী নদী দূষিত হচ্ছে। গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা ঝুঁকিতে থাকা ৮১ প্রজাতির দেশীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলোর চারা চরে লাগানোর দাবি জানান। তাতে কর্ণফুলী নদী প্রাণ ফিরে পাবে বলে তারা মনে করেন।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিনোদনের কোনো স্থান নাই। পৃথিবীতে অনেক দেশে নদী বা সাগরের মাঝখানের চরে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সেগুলো দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চর বাকলিয়ায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি ইকোট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

তারা দাবি জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই প্রকল্প বাকলিয়া চর থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যতায় তাঁরা সিটি করপোরেশন ঘেরাও সহ উচ্চ আদালতে নির্দেশ অমান্য করাসহ সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিকার প্রার্থনা করে রিট মামলা দায়ের করা হবে বলেও জানিয়েছেন।

কর্ণফুলীর ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, নিপীড়নে নিপীড়নে জর্জরিত একটি নদী। এই নদীর ওপর আর নিপীড়ন নয়। যে ছয়টি সংগঠন মিলে কর্ণফুলীর চরের ওপর বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে, তাদের দাবি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। এই ছয়টি সংগঠন সুপরিচিত। তারা সব সময় দেশের স্বার্থ, পরিবেশ ও মানুষের পক্ষে কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। এবারও দেশের স্বার্থেই তাদের আন্দোলন।

কোটি মানুষের চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। বর্জ্য শোধনাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে জায়গায় এটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেটি মোটেও  পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব এবং চট্টগ্রামবান্ধব হবে না। এই জন্য পরিবেশবাদীদের দাবি যত তাড়াতাড়ি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নেবে ততই দেশের মঙ্গল।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক